আনোয়ার চৌধুরীকে যখন বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার করা হয় তখন কোন কোন ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডে ছি ছি পড়ে গিয়েছিল! লেখা হচ্ছিল, আনোয়ার চৌধুরী তার জ্ঞাতিগোষ্ঠী সবাইকে ভিসা দিয়ে বিলাতে নিয়ে আসবেন! আদতে কি এমনকিছু হয়েছে? একজন পেশাদার কূটনীতিকের মতোই দায়িত্ব পালন করে গেছেন আনোয়ার চৌধুরী।
কমলা হ্যারিস মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হবার পর ভীষন তোলপাড় হয় ভারতীয় জনমানস আর মিডিয়ায়! কমলার ভারতীয় মায়ের পূর্ব পুরুষের এলাকার মহিলারা নানান পূজার আয়োজন করেন। কমলা হ্যারিস মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবেই দায়িত্ব পালন করছেন।
তার আগামীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে যাতে কোন সমস্যা তৈরি না হয় সে জন্য কমলা হ্যারিস এখন পর্যন্ত ভারত সফরও এড়িয়ে চলছেন। কারন সব দেশ তার নেতাকে তার দেশের মতো করেই ভোটাররা চায়। অন্য কোন দেশের মতো করে নয়।
ঋষি সুনাকের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে খুব স্বাভাবিক ভারতীয় মিডিয়া এখন মাতোয়ারা। বিভিন্ন ভারতীয় মিডিয়া এ নিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে এবং এখনও তা করছে। নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, এ নিয়ে ভারত-ব্রিটেনের সম্পর্ক ঐতিহাসিক মোড় নেবে! কিন্তু আসলে কী তাই?
ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে ঋষির দাদা ভারতের পাঞ্জাব থেকে মরিশাসে গিয়ে বসতি গড়েন। সেখান থেকে তারা বিলাতে যান। মানে পরিবারটির ভারত অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে বেশ আগেই। ভারত মহাসাগরের মাঝখানে একটি দ্বীপ দেশ মরিশাস। ব্রিটিশরা রাজবন্দীদের আন্দামান আর মরিশাসে দ্বীপান্তর করেছিল।
মরিশাস ছিল ফ্রান্স কলোনী। দ্বীপের বাসিন্দারা ফ্রেঞ্চ জানেন বলে এখনও ফ্রেঞ্চ পর্যটকদের সেটি পছন্দের গন্তব্য। আবার আদি ভারতীয়দের দেশ হওয়ায় এখনও দেশটির মুদ্রার নাম রূপি। মুম্বাইর ছবির শুটিং এর জন্য সেটি পছন্দের গন্তব্য। সিনেমা হলেও ভারতের সঙ্গে মুম্বাইর ছবি মুক্তি পায়।
আবার দ্বীপ দেশটির মূল অর্থনৈতিক ফসল কিন্তু আখ আর চিনি। এই আখ চাষের বড় খামারগুলোর মালিকরা মূলত ব্রিটিশ। শ্রমিকরা ভারতের এবং বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিক। ভারতের পাঞ্জাব মরিশাস হয় বিলাত পৌঁছা তেমন একটি পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম ঋষি সুনাক।
তাকে নিয়ে ভারতীয়দের খুশির ছবিগুলো দেখতে দেখতে ঐতিহাসিক একটি ঘটনা মনে পড়ছিল। ভারতের যে নির্বাচনে সর্বশেষ কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরেছিল সেই নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে আমি তখন ভারতে অবস্থান করছিলাম। এখন যেমন ভারতীয় মিডিয়া ঋষির পূর্বপুরুষ খুঁজতে পাঞ্জাব চষে বেড়াচ্ছে, ঠিক তেমনি তারা তখন ইতালি চলে গিয়েছিল।
সোনিয়া গান্ধীর জন্ম শহর-জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বক্তব্য ভারতীয় মিডিয়ায় এমনভাবে আসে যে তা কংগ্রেসের জন্যে নেতিবাচক হয়ে দাঁড়ায়। বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজ ঘোষনা দিয়ে বলেন, অসম্ভব। একজন বিদেশিনী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননা। এমন হলে তিনি মাথা ন্যাড়া করে মাটিতে গড়াগড়ি করবেন।
তবু কোন বিদেশিনীকে ভারতবর্ষের নেতৃত্বে বসতে দেবেননা। ঠান্ডামাথার সোনিয়া গান্ধী তখন মাথা ঠান্ডা সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ঘোষনা দিয়ে বলেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেননা। প্রধানমন্ত্রী হবেন মনমোহন সিং। এই ঘটনায় গান্ধী পরিবারের বিদেশিনী বধূ সোনিয়ার প্রতি ভারতবাসীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আরও বাড়ে।
আর এই ঋষি একজন ভারতীয় হিসাবে নয়, একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিসাবে ব্রিটেনের আলো-হাওয়ায় একজন ব্রিটিশ নাগরিক হিসাবে বড় হয়েছেন। একজন ব্রিটিশ নাগরিক হিসাবে মূলধারার রাজনীতিতে জড়িয়ে এমপি হয়ে এখন টোরি দলের নেতা হিসাবে প্রধানমন্ত্রিত্ব পর্যন্ত পৌঁছেছেন।
তাঁর স্কুল থেকে শুরু করে সব পড়াশুনা ব্রিটেনে হওয়াতে ভারতীয় একসেন্টে তিনি কথাও বলেননা। কিন্তু তাঁর প্রধানমন্ত্রী হবার বিষয়টি নিয়ে শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশ পর্যন্ত আলোড়নের উল্টোপিঠের গল্পও চলে আসছে। গান্ধী পরিবারের বিদেশিনী বধূ সোনিয়া জীবনের বড় অংশ ভারতে কাটালেও ভারতীয়দের কাছে ভারতীয় হতে পারেননি।
অথচ ভারতীয়-বাংলাদেশী-পাকিস্তানীরা পৃথিবীর নানা দেশে গিয়ে আগারটা-তলারটা সবটাই চেটেপুটে খেতে চায়! ২০০৬ সালে আমি বিলাতে নামার ঘটনাটি এখানে মজা করে লিখি। বিমান থেকে লক্ষ্য করলাম রানওয়েতে আজকের ঋষির পূর্বপুরুষ কিছু ভারতীয় রানওয়েতে হাঁটছেন!
প্রশ্ন উঠতে পারে আমি কিভাবে নিশ্চিত হলাম রানওয়েতে হাঁটতে থাকা লোকজন যে ভারতীয় এবং ঋষির পূর্বপুরুষ? কারন তাদের মাথায় শিখ পাগড়ি পরা ছিল। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে মাথায় শিখ পাগড়ি মাথায় বাঁধা লোকজনকে দেখে তাদের ভারতীয় অথবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ধারনা করা যায়। ঋষির পূর্বপুরুষরাও ভারতের পাঞ্জাব থেকে গেছেন।
বিলাতের প্রাচীনতম বাংলা সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকাটি আমার বিলাত সফরের আমন্ত্রন করেছিল। জনমতের তৎকালীন প্রধান দুই ব্যক্তিত্ব নবাব উদ্দিন ও সৈয়দ নাহাস পাশা এবং লেবার পার্টির প্রভাবশালী সংগঠক আমিন উদ্দিন আমাকে হাউস অব কমন্সে ভারতীয় ব্রিটিশদের আয়োজন করা একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে যান।
দিওয়ালি উপলক্ষে সেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তখনই অভ্যাগতদের দেখেশুনে ব্রিটিশ রাজনীতিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের প্রভাব সম্পর্কে ধারনা করতে পারি। যারা হাউস অব কমন্সে দিওয়ালির আয়োজন করতে পারেন। ২০০৬ সালের ঘটনা। বিলাতে তখন লেবার পার্টি ক্ষমতায়।
টনি ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী। এই ঋষি সুনাকও তখন নিশ্চয় বাচ্চা ছেলে। টোরি দলের নেতা বিরোধীদলের নেতা ডেভিড ক্যামেরন সেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। আমাকে বলা হয়েছিল বিলাতে আগামীতে টোরি দল ক্ষমতায় এলে ইনিই তথা এই ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী হবেন। তাই হয়েছে।
সেই ব্রিটিশ রাজনীতিতে প্রভাবশালী ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের প্রতিনিধি ঋষি সুনাককে ১০নং ডাইনিং স্ট্রিটের চাবি পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বেশি সংখ্যক এমপিদের সমর্থন থাকলেও শুরুতে টোরি দলের ভোটাররা তাকে এড়িয়ে লিজ ট্রাসকে বেছে নেন।
লিজ ব্যর্থ হবার পর উপায়হীন ঋষিকে বেছে নেয়া হয়েছে। এটাকে ভারতীয়দের বিলাত জয় বলা কী সঙ্গত হবে? এক্ষেত্রে সাজিদ জাভিদ যদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে এটাকে কী পাকিস্তানীদের বিলাত জয় বলা হতো কী? পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদের পদত্যাগের মাধ্যমে কিন্তু বরিস জনসনের পতন শুরু হয়েছিল। এরপরও এখন পর্যন্ত বিজয়ী ঋষি সুনাক অভিনন্দন।