মনোরঞ্জন হাজং ভালো নেই। কিন্তু এরমাঝে বাংলাদেশের হাজার ইস্যুর ভিড়ে তাঁর কথা আমরা ভুলতে বসেছি! কক্সবাজারে পর্যটকদের গলা কাটতে দা’ও বাড়িয়ে বসেছিল হোটেল মালিকরা! পনেরশো টাকার রূমের ভাড়া নিয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাতের প্লেট ৪০০ টাকা! বাংলাদেশের এসব বদমায়েশির মাঝে ট্যুরিজম ধেই ধেই করে বেড়ে উঠবে!
অনেক দিনের জমানো টাকায় স্বপ্নের কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে গণধর্ষনের শিকার হয়েছেন আট মাস বয়সী এক বাচ্চার মা! এরপর ঝালকাঠিতে মাঝনদীতে লঞ্চের আগুনে বারিকিউ হয়ে গেছেন অনেক লঞ্চযাত্রী! এত ইস্যুর ভিড়ে সুখি মানুষটি বুঝি বিচারপতি রেজাউল হাসান! যিনি তার ছেলে সাইফ হাসানের গ্রেফতার এখনও ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছেন!
মনোরঞ্জন হাজং এর সর্বশেষ জানতে শুক্রবার ফোন করেছিলাম ঢাকায়। ভালো নেই মনোরঞ্জন হাজং। তিনি এখন প্রায় অসহায় শিশুর মতো কাঁদেন। আগে যিনি সবাইকে ভরসা দিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন, তিনি এখন নিজেই ভরসা পাচ্ছেননা। তাঁর স্বজনদের শান্তনা দিয়ে বলার চেষ্টা করি, এটাইতো স্বাভাবিক। সে রাতে প্রানে বেঁচে গেলেও তাঁরতো একটি পা কেটে ফেলা হয়েছে।
আরেক পায়ের অবস্থা ভালো নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে নেয়া কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধা যে ব্যক্তি বিজিবি’র হাবিলদারের পদ থেকে অবসর নেবার পর একটি সিক্যুরিটি কোম্পানিতে কাজ নিয়েছিলেন, জীবনে একদিনের জন্যে যিনি পরনির্ভর ছিলেননা, তিনি আজ ভাবছেন বাকি সারাজীবনের জন্যে পরনির্ভর হয়ে গেলেন! এমন একটা লোক ভালো থাকেন কি করে।
ডাক্তাররা এখন মনোরঞ্জন হাজং এর অপর পায়ের ইনফেকশন নিয়ন্ত্রনের প্রানান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁর আরও একাধিক অস্ত্রোপচার করা দরকার। কিন্তু এখনও অস্ত্রোপচারের শারীরিক অবস্থায় নেই মনোরঞ্জন হাজং। এরমাঝে তাঁর একবার হার্ট এটাকও করেছে। এরজন্যে দু’বার অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে তাকে ফেরত আনা হয়েছে। কারন ডাক্তারদের আশংকা এ অবস্থায় তাঁকে এনেসথেসিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচারের জন্যে অজ্ঞান করলে তাঁর জ্ঞান আর নাও ফিরতে পারে।
আমি অনলাইনে মাছরাঙা টিভিকে দেয়া মনোরঞ্জন হাজং এর মেয়ে মহুয়া হাজং এর সাক্ষাৎকারের পুরোটা শুনেছি। সেখানে মহুয়া তাঁর বাবা’র শারীরিক অবস্থার অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করে বলেছেন। একটি পা কেটে ফেলার পর মনোরঞ্জন একদিন অস্থির প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলেন। পরে জানা যায় সেদিনই তাঁর হার্ট এটাক করেছিল।
গত ২ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে মনোরঞ্জন হাজংকে গাড়ি চাপা দেয় বিচারপতি রেজাউল হাসানের ছেলে সাইফ হাসান। মনোরঞ্জন তখন রাস্তা পেরোবার জন্য তাঁর মোটরবাইকে বসা অবস্থায় অপেক্ষমান ছিলেন। ওই অবস্থায় তাকে গাড়িচাপা দিলে উপস্থিত জনতা গাড়ি সহ বিচারপতি রেজাউল হাসানের ছেলে সাইফকে বনানী থানার পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
বনানী থানার পুলিশ শুরুতে সাইফ হাসানকে গ্রেফতারও দেখিয়েছিল। কিন্তু তার বিচারপতি বাবা রেজাউল হাসান ফোন করে বনানী থানার পুলিশকে গরম দেখালে উর্ধতন চাপের কথা বলে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। ওই ঘটনার রাত সাড়ে তিনটার দিকে মহুয়াকে ফোন করে ঘটনা জানানো হয়।
মহুয়া হাজং ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশে সার্জেন্ট হিসাবে কাজ করেন। মহুয়া তখন ঘটনা জানাতে তার ভাই মৃত্যুঞ্জয়কে ফোন করেন। কিন্তু অত রাতে ঘুমের মধ্যে ফোন ধরতে পারেননি মৃত্যুঞ্জয়। সকাল সাতটার দিকে তিনি তার দিদিকে ফোন করে ঘটনা জেনে হাসপাতালে ছুটে এসে তাদের পরিবারের সর্বনাশ দেখেন।
এরপর চলতে থাকে মনোরঞ্জন হাজং এর চিকিৎসা আর মামলা দায়েরের সংগ্রাম। মহুয়া ট্রাফিক পুলিশের সদস্য হওয়া স্বত্ত্বেও পুলিশ মামলা নিতে চায় না। কারন ফোনের অপরপ্রান্তে বসে আছেন এক রদ্রমূর্তির বিচারপতি! ন্যায় বিচারের জন্যে তাকে বিচারপতি হিসাবে শপথ পড়িয়ে বিচারালয়ে বসিয়েছে রাষ্ট্র। বিচারপতির বেআইনি গরম দেখিয়ে তিনি ছেলের পক্ষে ফোনে শাসান একজন ঢাকার একটি থানার ওসিকে!
শুরুতে ঘটনা নিয়ে দেশের মূলধারার মিডিয়া কোন রিপোর্টও করেনি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় একেরপর ফুটেজ ভাইরাল হতে থাকলে মূলধারার মিডিয়া আর চোখ থাকিতে অন্ধ থাকতে পারেনি। মূলধারার মিডিয়া প্রথম দিকে বিচারপতি রেজাউল হাসানের নাম উল্লেখ না করলেও পরে নাম উল্লেখ করে রিপোর্ট করতে থাকে।
কিন্তু এরমাঝে অনুসন্ধিৎস্যু চোখ এড়ায়না একটি বিষয়! বনানী থানার ওসির বিচারপতি রেজাউল হাসানের বাড়িতে যাওয়া আসার বিষয়! এভাবে চোর-পুলিশ মিলে সাজায় সাজানো মামলা ভাষা! ঘটনার ১২ দিন পর বিচারপতি রেজাউলের হাসানের ছেলে সাইফ হাসানের নাম উল্লেখ না করে আসামী অজ্ঞাত লিখে মামলা নেয় বনানী থানার পুলিশ।
কিন্তু এর দু’দিন আগে বিচারপতি রেজাউল হাসানের ছেলে সাইফ হাসানের একটি জিডি নেয় পুলিশ! তাতে লেখা হয় দোষ মনোরঞ্জন হাজং এর! তিনি মরতে পা হারাতে মোটর সাইকেলে করে তার গাড়ির নীচে এসে শুয়ে পড়েছেন! মামলা তদন্তের ভার পেয়ে ডিবি পুলিশ বলেছে তারা এই ঘটনার আদিঅন্ত জানে! বনানী থানার ওসির বিচারপতি রেজাউল হাসানের বাসায় যাতায়াতের বৃন্তান্ত জানে কী?
বিচারপতি রেজাউল হাসানের চাপে বনানী থানায় নেয়া জিডি এবং আসামী ‘অজ্ঞাত’ লিখে মামলা নেবার খবর জানাজানি হলে বিস্ফোরিত হয় মূলধারার মিডিয়া। বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সুপ্রিমকোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী জহিরুল ইসলাম খান পান্না ফেসবুক লাইভে এসে বিচারপতি রেজাউল হাসানের পদত্যাগ দাবি করে বলেন তিনি বিচারপতি সুলভ আচরন দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এরমাঝে মহুয়া হাজং এর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ! ডিএমপি কমিশনার মনোরঞ্জন হাজং এর চিকিৎসার জন্যে আট লাখ টাকার বেশি সহায়তার একটি চেক মহুয়া হাজং এর হাতে তুলে দিয়েছেন। যদিও এরমাঝে প্রথম ১৪ দিনে হাসপাতালের ৬ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করতে হয়েছে।
মহুয়া হাজং এর পর দাঁড়াতে হ্যাশট্যাগ আন্দোলনের আহবান জানাচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশের একাধিক তরুন সদস্য। তাদের পক্ষে থাকুন। সোশ্যাল মিডিয়া, মূলধারার মিডিয়া এখনও মনোরঞ্জন হাজং এর পক্ষে। কিন্তু কিছু অখ্যাত অনলাইন দিয়ে রিপোর্ট করাচ্ছেন এই বিচারপতি। তাতে বলা হচ্ছে পা কাটার দোষ মনোরঞ্জন হাজং’এর!
আমাকে একজন আদিবাসী ব্যক্তিত্ব বলার চেষ্টা করেছেন এই বিচারপতি রেজাউল হাসান নাকি অনেক সিনিয়র। তার নাকি প্রধান বিচারপতি হবার কথা! আমি তাকে বলেছি-ঘোড়ার ডিম হবে। এমন মাথা নিয়ে শেখ হাসিনা দেশ চালাননা।
এই যে আজ ডিএমপি মহুয়া হাজং এর পক্ষে একটি স্ট্যান্ড নিয়েছে, ৮ লাখ টাকার বেশি আপাতত সহায়তা দিয়েছে মনোরঞ্জন হাজং এর চিকিৎসার জন্যে, আমরা লিখতে থাকলে শেখ হাসিনাও একদিন গণভবনে ডাকবেন মহুয়াকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকা মানে মনোরঞ্জন বাবু’র উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থাও হবে।
কাজেই লেখালেখি বন্ধ করা যাবেনা। আমরা সোচ্চার থাকলে মনোরঞ্জন হাজং এর জীবন বিপন্নকারী বিচারপতি রেজাউল হাসানের ছেলে সাইফ হাসানের কোমরে গ্রেফতারের দড়ি আবার পড়বেই। অতএব জাগো বাহে কোনঠে সবায়------হাজং ভাষায় এই ডাক দেই আবার--“জাগগে উঠিক কুমায় আছে তোরা----!” মনোরঞ্জন হাজং এর ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামবোনা বাংলাদেশ।