ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক
আমাদের গ্রামে ও আশপাশের গ্রামে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি ,বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কলেজ ছাত্ররা বিভিন্ন বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা করে। লজিং এর আরো একটি বাংলা তরজমা আছে সেটা হলো, জায়গীর থাকা। বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েরা লজিং মাষ্টার বা জায়গীর সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই, তবে আমি বলতে পারি, ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে ৯০ দশক পর্যন্ত এই প্রথার প্রচলন বেশ ছিল, এখনও হয়তো আছে, তবে কম। বলে রাখা ভালো আমি কলেজ জীবনে লজিং থেকেছি।
মফস্বল শহরের বা একটু গ্রাম অঞ্চলের শিক্ষিত ছেলেরা, সাধারণত যেসব জায়গায় কলেজ আছে তার আশপাশের গ্রামে লজিং থেকে কলেজে পড়াশোনা করতো। আমি যে সময়ের কথা বলতে চাচ্ছি, সেটা ছিল পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকের কথা। ১৯৪০ সাল থেকেই আমাদের পাশের গ্রামের কলেজের বদৌলতে, অনেক ছাত্রদের বিভিন্ন বাড়িতে লজিং থাকতে দেখেছি। আমাদের অঞ্চলের মানুষ এই লজিং মাস্টারকে "মাসসাইব" বলে ডাকে। খুবই সম্মান করে যে বাড়িতে লজিং থাকে সেই বাড়ির ছেলেমেয়েকে পড়ান, বিনিময় এসে থাকতে ও খেতে পান। সেই সময় টিউশনির প্রচলন ছিল না।
লজিং মাস্টার বা জায়গীর সম্পর্কে ছোট খাট দুই একটি মুখরোচক গল্প আছে।
লজিং মাস্টারের ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তি নাকি বিড়ালের মত। লজিং মাস্টার যখন কলেজ থেকে এসে, ক্লান্তি ভরে কাচারি (বাংলা ঘর) ঘরে অথবা ঘরের বারান্দায় খাবার অপেক্ষায় থাকে, তখন সে নাকি বাড়ির ভিতরের প্লেট গ্লাসের শব্দ, এমনকি তরকারির ঘ্রাণ বারান্দায় বসে পায়, এবং সাথে সাথে সে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
লজিং মাস্টার কেমন আদর যত্ন পাবে তা অবশ্যই নির্ভর করে কোন বাড়িতে আছে। সেই বাড়িওয়ালার মানসিকতা কি রকম।
কোনবারির এক লজিং মাস্টার সাধারণ খাবার খেয়ে অভ্যস্ত, ভালো মাংস, মাছ, দুধ, ডিম খুব একটা তাকে দেওয়াই হয় না। কোন একদিন তার ছাত্র তাকে বড় একটা পিতলের গ্লাসে এক গ্লাস গরম দুধ এনে দিল। লজিং মাস্টার তো অবাক, হঠাৎ করে এত সুন্দর গ্লাসে এই পরিমাণ গরম দুধ। লজিং মাস্টার অতি আনন্দের সাথে মজা করে দুধ খেলো। একটু সন্দেহ হওয়ার পরে তার ছাত্রের কাছে, কানে কানে জিজ্ঞেস করলো, বলতো আজকে আমাকে এই পরিমাণ দুধ দিলে কেন? ছাত্র উত্তর দিল, দুধ যখন জালানো হচ্ছিল তখন একটি বিড়াল দুধের হাড়িতে মুখ দিয়েছিল, তাই ওই দুধ আমরা খাব না বলে আপনাকে মা দিয়েছে। তারপর মাস্টার জিজ্ঞেস করল, এত সুন্দর গ্লাসে কেন?
ছাত্রের উত্তর, আমার দাদী গতবছর মারা গেল, সে এই গ্লাসে পানের পিক ফেলত ও কাশি ফেলত। তাই দাদি মারা যাওয়ার পরে এই গ্লাসটা ব্যবহার হয় না, সেই জন্য আজকে পরিষ্কার করে, এই গ্লাসে আপনাকে দুধ দেওয়া হয়েছে।
উপরে যা উল্লেখ করলাম এটা গল্প তবে এই গল্পের বিপরীত চিত্রই বেশি ছিল, অনেকে তার বাড়ির মাস্টারকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসতো, বাড়ির অন্যান্য মানুষ ও আশপাশের মানুষ খুবই সম্মান করতো।
কারণ ছিল তখনকার দিনের শিক্ষিত মানুষ খুব কম ছিল, কোন আত্মীয়-স্বজন চিঠি পাঠালে, জরুরী কোন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠ করতে হলে লজিং মাস্টার কে দিয়ে পড়ানো হতো।
এটা ছিল পাকিস্তান আমলের শেষের দিকের কথা, সিএসপি অফিসার আবার বিয়ে করেন তার মানানসই পাত্রী দেখে
যখন তার স্ত্রীর সন্তান প্রসব হবে একটি মেডিকেল কলেজ হসপিটাল ভর্তি করেন।
প্রথম সন্তান প্রসবের সময় জটিল পরিস্থিতির তৈরি হয়, সিএসপি অফিসার তার আত্মীয় স্বজন ও চেলা চামুণ্ডাসহ, সবাই ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, হাসপাতাল থেকে সিএসপি কে আশ্বস্ত করা হলো, কোন চিন্তা করবেন না সবচেয়ে বড় গাইনি ডাক্তার এসে যাচ্ছে, বড় গাইনী ম্যাডাম এই ব্যাপারটা হ্যান্ডলিং করবেন।
যে কথা সেই কাজ, বড় ডাক্তার ম্যাডাম খুবই পরিশ্রম করে, সন্তান প্রসব করালো, সকলের মুখে ধন্য ধন্য পড়ে গেল, সিএসপি ও সাথের লোকজন বাংলা মায়ের এই কৃতি ডাক্তারের প্রশংসা করতে লাগলো।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে, সিএসপি খুশিতে আত্মহারা হয়ে হাসিমুখে সন্তানকে কোলে নিতে গেলেন। বড় ডাক্তার ম্যাডাম হাসিমুখে বাচ্চাটিকে তার বাবার কোলে দেওয়ার জন্য দরজার কাছে আসলেন। দুজনে সন্তান বিনিময়ের সময় চোখাচোখি হলেন। বড় ডাক্তার ম্যাডামের মুখের মৃদু হাসিটা একটু প্রসারিত হলো, সিএসপি সাহেবের খুশির ভাবসহ মুখের হাসি মলিন হয়ে চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
বড় ডাক্তার ম্যাডাম ক্লিনিক থেকে চলে গেলেন ৭ দিনে আর ক্লিনিকে আসলেন না। সিএসপি সাহেব তার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে, ডাক্তার ম্যাডামের সাথে দেখা করতে না পেরে ভিজা চোখে বাসায় গেলেন।
বড় ডাক্তার ম্যাডাম ছিলেন, সিএসপি অফিসার সাহেব যে বাড়িতে লজিং থেকে সিএসপি হয়েছেন সেই বাড়ির বড় মেয়ে, এক সময়ের সিএসপি সাহেবের অযোগ্য স্ত্রী।
পরবর্তীতে সিএসপি সাহেব সচিব হিসেবে রিটার্ড করেন, পরে কোন এক স্বৈরাচারের কেবিনেট মন্ত্রী হন। কোন এক সময় শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার কারণে তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর ছিল শুধু বাসায় বন্দুকসহ দারোয়ান।
একদিন দারোয়ানের বন্দুক চুরি হয়ে গেল। তখন আদর করে লোকজন জনাব, সিএসপি সাহেবকে, "বন্দুক বিহীন মন্ত্রী" উপাধি দিল।
"সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে রচিত গল্প।"