জি-টুয়েন্টি জোটের সদস্য দেশ নয় বাংলাদেশ। ভারতের উদ্যোগে সেখানে বাংলাদেশকে স্পেশাল গেষ্ট হিসাবে দাওয়াত করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সম্মেলনে যেভাবে শেখ হাসিনাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তা প্রমান করেছে, বাংলাদেশ কোন পার্শ্ব চরিত্র নয়।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা কী হবে এটি দেশের রাজনীতিতে এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। কারন ২০১৪, ২০১৮’র নির্বাচন এখানে ভারতের ইচ্ছায় হয়েছে। ২০১৪’র সেই নির্বাচন এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা করতে চাননি। এরশাদ-খালেদার মতো একটি একতরফা নির্বাচনের দায় নিতে চাননি। ভারতের তরফে বলা হয় না, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার একটি নির্বাচন হতে হবে। একটি টিভি চ্যানেলের অফিসে সেই বৈঠক হয়।
আন্দোলনের ধারবাহিকতায় সরকারের পতন হয়ে গেলে টিভি চ্যানেলটি বিএনপি-জামায়াতের উগ্র নেতাকর্মীদের হাতে আক্রান্ত হতে পারে, এ আশংকা করা হচ্ছিল। সে জন্যে লন্ডন থেকে তাদের সম্প্রচারের প্রস্তুতিও নেয়া হয়। কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে যাওয়ায় এর দরকার আর লাগেনি।
২০১৮’র নির্বাচনেও শেখ হাসিনা এক রকম ব্ল্যাকমেইলিং এর শিকার হন! বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনের আগে বিরোধীদলের একটি জনপ্রিয় দাবি থাকে অমুক বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেই বাহিনী মোতায়েনই সরকার ও বিরোধীদলের জন্যে বুমেরাং হয়েছে!
বিএনপি সহ সব দলের অংশগ্রহনে নির্বাচন হচ্ছে দেখে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পরিশ্রমী প্রচার চালাচ্ছিলেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগই জিতবে এটা নানাভাবে জানা যাচ্ছিল। কিন্তু সেই বাহিনী ঝুঁকি নিতে চায়নি! তারা এমন কাজ করলো যা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরাও জানতো না।
কিন্তু বদনামটা তাদেরই নিতে হচ্ছে। বিএনপি সেই নির্বাচন নিয়ে এতকিছু বলে। সেই বাহিনীর কথা বলেনা! অথচ তাদের জন্ম তাদের ঘরে। হিসাব-নিকাশ সব পাল্টে গেছে। খালেদা জিয়া যে আজ কারাগারে, এটি তাদের মামলা। স্বাক্ষী প্রমান এত শক্ত ছিল যে সাজা এড়াতে পারেননি।
তারেক রহমানের কোমর তাদের হাতে ভেঙ্গেছে। কোমর ভাঙ্গার চিকিৎসার নামে সেই যে মুচলেকা দিয়ে দেশ ছাড়লেন। আর ফিরতে পারলেননা। এখনতো তার বাংলাদেশের পাসপোর্টই নেই। যদি কোনদিন তার বাংলাদেশে ফেরার দিন-তারিখ হয়, আগে একটি পাসপোর্ট অথবা ট্র্যাভেল ডকুমেন্টস বানাতে হবে।
খালেদা জিয়া উচ্ছেদ হয়েছেন সেনানিবাসের বাড়ি থেকেও। এটা তার জন্যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ছিল! সেই যে হুমকি দিয়েছিলেন! ক্ষমতায় গিয়ে দেখে নেবার হুমকি! খন্দকার দেলোয়ারের পাশে বসে মিডিয়ার সামনে বাড়ি হারানো নিয়ে তার সেই কি যে কান্না। এটা তাকে লোভী হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
কারন এরশাদ থেকে তিনি গুলশানে আরেকটি বাড়ি পাওয়ায় স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেননি। স্বামী হত্যার বিচার দাবি করলেই তাকে এরশাদকে ধরতে হতো। এরশাদ তখন তাকে মাসিক ভাতাও দিতেন। সেই বাড়ি তিনি ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানিকে ভাড়া দিয়েছেন। দেশের আইন অনুসারে এক ব্যক্তি দুটি সরকারি বাড়ি পেতে পারেননা।
সেই নয় বিঘা জমিতে কয়েকশ ফ্লাট বাড়ি করে সেখানে কয়েকশ সেনা অফিসারের পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করেছেন শেখ হাসিনা। তাদের মধ্যে বিডিআর বিদ্রোহে নিহতদের পরিবারও আছে। এমন নানাকিছুর কারনে অতীত অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে।
এরজন্যে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বাহিনী প্রধান মিডিয়াতে বলেছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আর হয়নি! কত টাকা নেয়া হয়েছিল সেই কান্ডে! বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ধংসের জন্যে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী।
জেনারেল জিয়া-এরশাদ গণভোটের নামে দেশে ভোট ডাকাতি চালু করেন। এখনকার প্রজন্ম ভোট দিতে না পেরে আওয়ামী লীগকে দুষছে। কিন্তু আগের নির্বাচনগুলো ফেরেস্তারা করেননি। এরশাদ-খালেদাও ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন করেছিলেন ১৯৮৮, ১৯৯৬ সালে। এরশাদের সেই নির্বাচনে আ স ম আব্দুর রব গৃহপালিত বিরোধীদলের নেতা হন।
বাংলাদেশে নির্বাচন এলেই ভারতের একটি ভূমিকা সামনে চলে আসে। ধান-চালের দাম-পিঁয়াজ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের নানাকিছু ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ভারত এখন একটি পুরোপুরি ব্যবসায়িক রাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ না বিএনপি ক্ষমতায় থাকলো এসব এই কিছুদিন আগেও ব্যবসায়ী রাষ্ট্রটির চিন্তা-পরিকল্পনায় ম্যাটার করতোনা।
পাকিস্তান তথা আইএসআইর পক্ষ নিতে গিয়ে পায়ে কুড়াল মেরেছে বিএনপি। দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনা ধরা পড়ার পর বিএনপি ভারতের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা ঢাকায় সপরিবারে থেকে ভারত সীমান্তে অপারেশন চালাতেন!
সীমান্তে এসব সামাল দিতে প্রতিবছর হাজার কোটি রুপির বেশি খরচ হতো ভারতের। বিএনপি ক্ষমতায় নেই বলে এই খরচগুলো ভারতের নেই। বিএনপিও জানে বাংলাদেশে ক্ষমতায় যেতে বা থাকতে কোন না কোন ভাবে ভারতের আশীর্বাদ দরকার। ভারতীয় মনোভাব বুঝে বিএনপি দ্বারস্থ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।
ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসও এখানে একটি ইস্যু। কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ভিসা নীতি যেটা বলা হয়েছে তা একটি স্বাধীন দেশের জন্যে অপমানকর। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের চোখেমুখে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঘৃনা-বিদ্বেষ! ইউরোপীয় ইউনিয়ন-জাতিসংঘ এসব আমেরিকাকে জি হুজুর জাহাপনা বলে চলতে ভালোবাসে!
এ অবস্থায় কনফারেন্স ডিপ্লোমেসি চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় টুয়েন্টিফোর সেভেন প্রাইম মিনিস্টার হওয়াতে নানাকিছু তাঁর দক্ষতা জৌলুস এখন তাঁর বাপের চাইতে বেশি। গত ১৫/১৬ বছরে ভারত-আমেরিকা-চীন-ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানি-রাশিয়া থেকে শুরু করে যে যখন যা ব্যবসা চেয়েছে তিনি তা দিয়েছেন!
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো না হলেও অর্থনৈতিক সম্পর্কও খারাপ নয়। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব অর্থনীতির চিপায় পড়েছে বাংলাদেশ। ব্যাংকে রেমিটেন্স কম আসছে। টাকা আসছে হুন্ডিতে। রেমিটেন্স কমে যাবার পিছনে সংশ্লিষ্ট দেশের আইনকানুনও দায়ী।
এ অবস্থায় দেশে চাপে থাকা শেখ হাসিনাকে কনফারেন্স ডিপ্লোমেসিতে সহায়তা করছে ভারত। ব্রিকসের পর জি-টুয়েন্টি সামিটে তিনি যে গেছেন, সবকিছু ভারতীয় ছকে চলছে। জি-টুয়েন্টি সামিটে জো বাইডেনের সেলফি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল ছবি গলায় ঝুলিয়ে রাখতে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন!
আসল সত্য ছবি এখন সবাই চায়। হোয়াইট হাউসেও নিয়মিত মিডিয়া ব্রিফিং হয়। বিএনপির ব্রিফিং, কর্মসূচিতে ফটোসাংবাদিক, টিভি ক্যামেরা না পৌঁছা পর্যন্ত তারা কি তা শুরু করেন? আমরা যখন সাংবাদিকতায় আসি ইত্তেফাকের সাংবাদিক না পৌঁছা পর্যন্ত অনুষ্ঠান শুরু হতোনা!
এরপর শুরু হয় একুশে টিভির জন্যে অপেক্ষা! এখনতো প্রিন্ট মিডিয়ার চাইতে ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ার কদর বেশি। সোশ্যাল মিডিয়া এখন আরও শক্তশালী। স্পট থেকে লাইভ সম্প্রচার শুরু হয়ে যায়! এমন এক বাস্তবতায় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি জো বাইডেন তোলায় তা এখন বিশ্বমিডিয়ারও ভাইরাল আইটেম।
এ নিয়ে মির্জা ফখরুলের হতাশার কথাবার্তার যৌক্তিক কারন আছে। হতাশা প্রকাশ করতে গিয়ে একটি বর্নবাদী মন্তব্যও করে ফেলেছেন ফখরুল! বলেছেন, বাবুর্চিরাও ভিভিআইপিদের সামনে পেলে সেলফি তুলে! বাবুর্চিরা কাজ করে খায়। পাচারের টাকায় লন্ডনে জীবন চালায় না।
সেই অনুষ্ঠানে সেলফির চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের কর্মক্ষেত্র জেনে ভবিষ্যতে যোগাযোগের জন্যে তাঁর বিজনেস কার্ড সংগ্রহ করেছেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি! পুতুল পড়েছেন মার্কিন মুল্লুকে। কানাডায়। তাঁর আন্তর্জাতিক মানদন্ডের শিক্ষাকে বাইডেন চাইলে অনেক বেশি কাজে লাগাতে পারবেন।
মির্জা ফখরুল বলেছেন, সেলফি তুললেও নিষেধজ্ঞা, ভিসা নীতি এসব বাতিল-প্রত্যাহার হয়ে যায়নি! কথা সত্য। আরও সত্য হলো সেলফি ভাইরাল হবার পর জো বাইডেন কোথাও বলেননি যে, সরি-এদের সঙ্গে ছবি তোলা ঠিক হয়নি। মির্জা ফখরুলদের জন্যে আরেক দুঃসংবাদ অন্যখানে!
সেলফির ঘটনা হয়তো তাৎক্ষনিক হয়েছে। বুদ্ধিমতি শেখ হাসিনা-পুতুল তা ক্যাশ করেছেন। এবং তা খুব ভালোভাবেই করেছেন। কিন্তু জো বাইডেনের সঙ্গে ডিনারের টেবিলে কারা কারা থাকবেন তা তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে হয়নি। এটা ঠিক করেছে ভারত। শেখ হাসিনাকে বাইডেনের ডিনারের টেবিলে রেখে ভারত একটি বার্তা দিতে চেয়েছে। তারা শেখ হাসিনাকে চায়।
ভারতীয় মিডিয়া যেটা রিপোর্ট করেছে ভারতের জন্যে স্থিতিশীল রাজনীতির বার্তা। এমনিতে নানা কারনে দেশে চাপের মধ্যে আছে আওয়ামী লীগ। জি-টোয়েন্টি সামিটে জো বাইডেনের সঙ্গে ভাইরাল সেলফি, ঋষি সুনাকের মায়ের মতো শেখ হাসিনার পাশে বসা, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স সহ গুরুত্বপূর্ন নেতাদের সঙ্গে দেখা-কথা, ইমানুয়েল ম্যাক্রোর ঢাকা সফর, চাপমুক্তির টনিকের মতো কাজ করেছে।
ইমানুয়েল ম্যাক্রোর বক্তব্যে বাংলাদেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্তের বিষয়কে সুউচ্চে স্থান দেয়া হয়েছে। এখন নির্বাচনটা আওয়ামী লীগকে ভালো মতো করে করতে হবে। শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে ঘুরে এসে সংবাদ সম্মেলন করেন। আগামী সম্মেলনে সেলফি সহ নানান বিষয় গুরুত্ব পাবে।