ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক
"কর্তব্যে বিচ্যুতি"
এয়ারপোর্টের ওভারব্রিজের পশ্চিম পাশে দাঁড়ানো, হঠাৎ একটি লোক আমাকে সালাম দিয়ে কদমবুচি করতে উদ্যত হল, আমি তাকে যথাযথ থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে কি আমার চেনার কথা। লোকটি হেসে উত্তর দিলো, তার পরিচয় খুলে বলল, আমি চিনতে পারলাম। কোন এক সময় মাগুরায় তার সাথে পরিচয় হয়েছিল, বিবাহসূত্রে মাগুরায় তার যাতায়াত ছিল। নাম জিজ্ঞেস করলাম বলল, শহীদ। কুশলাদি বিনিময় করে আমার কাছ থেকে আমার ঠিকানা নিয়ে নিল বলল স্যার একসময় আপনার সাথে দেখা করব।
২০০৫ সালের প্রথম দিকে, আমি একটি বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করতে ছিলাম।
শহীদ আমার সাথে দেখা করল, আমি ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম তারপরও পুরনো সূত্র ধরে কথা বললে, আমি কাউকে নিরাশ করতে পারিনা।এটা আমার মজ্জাগত দোষ বটে। শহীদ বলল স্যার আমি একটি সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের, পরিদর্শক পদে চাকরি করতাম, আমাদের চাকরিটা ছিল প্রকল্পে, প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পর,বেকার অবস্থায় আছি। একটি মাত্র ছেলে পাঁচ বছর বয়স ও স্ত্রীকে নিয়ে খুবই কষ্টে আছি, যদি দয়া করে কোন একটি চাকরি দিতেন তাহলে আমার সংসারটা বেঁচে যেত।
সেই সময় আমার কোম্পানির নিয়োগ-প্রক্রিয়ার প্রধান ব্যক্তি আমি ছিলাম, চিন্তা করে দেখলাম পরিদর্শক পদে অভিজ্ঞতা আছে, সর্বোপরি ছেলেটির মুখের আকুতি দেখে, আমি তাকে ২৪ হাজার টাকা বেতনের এক্সিকিউটিভ পদে চাকরি দিলাম। আমার ঢাকার হেড অফিস ১১২ জন সহ চিটাগাং এবং খুলনা মিলে প্রায় ১৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাদের কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ব্যক্তিগতভাবে সবার খোঁজ খবর আমি খুব একটা রাখতাম না, ম্যানেজার এইচআর এই কাজটি করতেন।
একদিন ম্যানেজার এইচআর, আমার কাছে এসে বলল, শহীদ এক সপ্তাহ যাবৎ কাজে অনুপস্থিত। আমি ম্যানেজারকে বললাম ওর ব্যক্তিগত ফাইলটি আমার কাছে নিয়ে আসুন।ব্যক্তিগত ফাইল দেখে একটি রেফারেন্স নাম্বার আমি পেলাম। ফাইলটি আমি নিজের কাছে রেখে ম্যানেজারকে বিদায় করলাম। রেফারেন্স নাম্বারে টেলিফোন করে পরিবারের নাম্বার নিলাম। নিজের পরিচয় দিয়ে সবিনয় জিজ্ঞেস করলাম শহীদ কোথায় কাজে অনুপস্থিত কেন?। পরিবার থেকে বলা হলো, আমার বাসায় একটু দেখা করতে চায় তারা। আমার একটু সন্দেহ হল, বাসায় দেখা করবে কেন অফিসের কাজের জন্য। যাহোক আমি অনুমতি দিলাম। শুক্রবার সকালে বাসায় বসে আছি দেখি শহীদের বড় ভাই ও ৫,৬ বছরের ছোট্ট একটি ছেলে আমার বাসায় এসে উপস্থিত।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম বাচ্চা ছেলেটা আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো খুবই নম্র ভদ্র একটি চাঁদের মত ছেলে। আমি যথারিতি চা নাস্তা দিতে বললাম, চা খাওয়ার ফাঁকে শহীদের বড় ভাই বলল, স্যার আপনার কাছে সত্যি কথা বলতে চাই, বললাম অবশ্যই সত্যি কথা বলবেন। ভদ্রলোক বললেন, শহীদ জেলে আছে, ওর সাত বছর জেল হয়ে গেছে। বুঝিয়ে বললো শহীদ যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো সেখান থেকে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হতো ইনসপেক্টর থাকা অবস্থায় কিছু ক্ষুদ্র ঋণ দিয়েছে, ৬৫ হাজার টাকার ক্ষুদ্র ঋণ খেলাপি হয়েছে। ওর প্রজেক্ট শেষ হওয়ার পরে ও মাগুরা থেকে চলে এসেছে। ওর বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওর উপর দোষ চাপিয়ে সার্টিফিকেট মামলা করার দরুন, ওর জেল হয়েছে। আমরা কেউই এ ব্যাপারে কিছু জানতাম না বলল, আমরা গরীব মানুষ, আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
আমি সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। শহীদের পূর্বের কর্মস্থলের সবকিছু রেখে দিলাম। আমি অফিসে গিয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করলাম, এখানে আমার কর্তব্য ও একটি বাচ্চা ছেলের মুখের ছবি বারবার এদিক সেদিক করতে লাগলো। সেই সময় শহীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ের একজন কর্তাব্যক্তি আমার পরিচিত ছিল। আমি সরাসরি ওই কর্তাব্যক্তির অফিসে চলে গেলাম, আমার অফিস এবং ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় কারওয়ানবাজারে ছিল। ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে আমি সবকিছু খুলে বললাম ভদ্রলোক বললেন তুমি তিনদিন পরে আসো।আমি তিনদিন পরে ভদ্রলোকের অফিসে যথারীতি গেলাম, ভদ্রলোক খুব বিমর্ষ মুখে বললেন, এখানে এই ছেলের কোন দোষ নেই, দোষ যদি কিছু করে থাকে, মাগুরার জেলা পর্যায়ের এই বিভাগের কর্মকর্তারা করেছে। প্রজেক্ট শেষের পরে শহীদ চলে আসবে সেটাই স্বাভাবিক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য শহীদের নামে লাইবেলিটি চাপিয়ে দিয়েছে। এখন এই অবস্থায় আমাদের কিছুই করণীয় নাই যেহেতু চার বছর আগের ঘটনা শহীদের অনুপস্থিতিতে মামলার রায় হয়েছে, এখন ওর ঊর্ধ্বতন আদালতে গিয়ে মামলা মোকাবেলা করতে হবে।
আমার মনে কেমন যেন, ছোট ছেলেটির মুখের ছবি স্থায়ী দাগ করে নিল। শহীদের ফাইলটি আমার কাছে রেখে রেফারেন্স নাম্বার টি ভালো করে কেটে মুছে দিলাম, ম্যানেজার যেন ওর কোন খোঁজ না করতে পারে।
সারাদিন বিষণ্ন মনে অফিস করলাম, রাত্রে বাসায় বসে চিন্তা করলাম, বাচ্চা ছেলেটার মুখের এই হাসি কেমন করে আমি বাঁচিয়ে রাখবো, সুইজারল্যান্ডের কোম্পানি এখানে কোন রকম কোন অন্যায়ের প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। রাতে অনেক চিন্তার পরে শহীদের বড় ভাইকে টেলিফোন করলাম। বললাম আপনি আমার বাসায় সকালে আসবেন। শহীদের বড় ভাই আসলো, বললাম আপনি আমার বরাবর একটি দরখাস্ত লেখেন, লিখবেন শহীদের ক্যান্সার ধরা পড়েছে গোপন পথে ইন্ডিয়া গিয়ে ও চিকিৎসা নিচ্ছে, আমি যেন ওর চাকরিটা বাঁচিয়ে রাখি।
পরেরদিন শহীদের বড় ভাই আমার অফিসে দরখাস্ত নিয়ে গেল। আমি যথারিতি দরখাস্ত আমলে নিয়ে কাজ আরম্ভ করলাম। সুইজারল্যান্ডের হেড অফিসে একটি মেসেজ দিলাম আমাদের একজন এক্সিকিউটিভ ক্যান্সারাক্রান্ত অত্যন্ত গরীব বিধায় সে ইন্ডিয়ায় চিকিৎসা নিচ্ছে, কোন ডকুমেন্ট পাঠানো যাবে না, কেননা শহীদ স্থলপথ দিয়ে পাসপোর্ট এর ঝামেলা এড়ানোর জন্য তাড়াতাড়ি হসপিটালে ভর্তি হয়েছে।
আমার এই মেসেজে কাজ হল, হেড অফিস থেকে শহীদের জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্দ হলো, চিকিৎসার জন্য। শহীদের ভাইয়ের কাছে আমি দুই লাখ টাকা পৌঁছে দিলাম বললাম,আমার অফিসের অন্য কারো সাথে কোনরকম যোগাযোগ না রাখতে। বললাম হাইকোর্ট থেকে জামিন এর ব্যবস্থা করতে,
নিয়ম অনুসারে প্রথমে জেলা জজের কাছে আপিল করল, আপিল খারিজ হল হাইকোর্ট থেকে জামিন করাতে চার মাস কেটে গেল। সব কিছু মেলে পাঁচ মাস পরে শহীদ কাজে যোগদান করলো যথারীতি সকল বেতন সহ ওর কাজ পুনরায় আরম্ভ করলো। তিন বছর পরে আমার সেই বহুজাতিক কোম্পানিটি বাংলাদেশ থেকে তাদের কার্যক্রম গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। সবাইকেই মিনিমাম একটা বেনিফিট দিয়েছিল সেখান থেকেও শহীদ প্রায় তিন লাখ টাকা পেয়েছিল।
তারপর প্রায় ১১ বছর কেটে গেল আমি ওই কোম্পানির কোন খবর আর রাখিনি প্রাক্তন সহকর্মীদের সাথে ও খুব একটা যোগাযোগ নাই।
গত মার্চ মাসে আমি বাসায় বসে আছি হঠাৎ করে আমার বাসায় তিনজন মানুষ এসে হাজির। একটা ছেলে মনে হয় ইউনিভার্সিটিতে পড়ে ভদ্রলোকের একটু দাড়ি সাথে এক ভদ্রমহিলা।
বাসায় এসে ড্রইংরুমে বসল সবাই। আমি ড্রইং রুমে যেতেই বলতে গেলে তিনজন একত্রে কদমবুচি করতে আরম্ভ করলো, আমি বললাম এসব করতে হবে না আপনারা কারা বলেন, স্যার আমার নাম শহীদ, যাকে আপনি চাকরি দিয়েছিলেন, চাকরি রক্ষা করেছিলেন, আমার পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন। আপনার কথা কোনদিন ভুলতে পারবো না, অনেক কষ্ট করে আপনার বাসা খুঁজে, আপনার বাড়িতে এসেছি।
আমার ছেলেটি আজ একটি স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। কাল থেকে ক্লাস শুরু আপনি ওর মাথায় হাত রেখে ওকে দোয়া করে দিন, যেন আপনার মত ও মানুষ হতে পারে।
আমি এই ঘটনা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে পিছনের কথা মনে পড়ে গেল। হয়তো এই ছেলে একদিন ওর পরিবারের এই দেশেরই মুখ উজ্জ্বল করবে। আবার ভিতরে ভিতরে লজ্জায়, মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল, আমি আমার কর্তব্যে কত বিচ্যুতি করেছিলাম।
এখানে কর্মের বিচ্যুতি করেছিলাম, না একটি অসহায় পরিবারকে সামান্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিলাম, কোনটা ভালো ছিল, এর হিসাব মেলাতে পারছি না, আর পারবো বলে মনে হয় না।