ক্যামেরার সামনে বিজয় চিহ্ন যখন সেলিনা হায়াৎ আইভী দেখাচ্ছিলেন, তখন ভোটের পূর্ণাঙ্গ ফল না এলেও তার বিজয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি/বিডিনিউজ
ইউপি নির্বাচনের ফলাফলে অনেকে বলা চেষ্টা করছিলেন সারাদেশে নৌকার অবস্থা ভালোনা। নারায়নগঞ্জে ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভীর হ্যাট্রিক বিজয় সেখানে আওয়ামী লীগের জন্যে এক পশলা স্বস্তির বৃষ্টির মতো মনে হবে। আইভী প্রমান করেছেন কাজ করলে ভোটাররা কাজের মূল্যায়ন করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে একজন কাজপাগল মানুষ। নিজে সারাক্ষণ কাজের মধ্যে থাকেন। যারা কাজ করেন তাদের মূল্যায়ন করেন। ডাঃ আইভীকে এবারও তিনি আবার মনোনয়ন দিয়েছেন একক উদ্যোগ-সিদ্ধান্তে। শামীম ওসমান প্রভাবিত নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগ আইভীর নাম পাঠায়নি।
তিনটি নাম পাঠানো হয় কেন্দ্রে। কিন্তু শেখ হাসিনা এসব বোঝেন বলেই তিনি দেশ চালান। ওই তিন জনের নাম ঘ্যাচাং কেটে তিনি সেখানে আইভির নাম লিখেন। এভাবে নাসিক নির্বাচনের আবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন আইভি। শামীম ওসমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরন এতে হবারই কথা।
আওয়ামী লীগের নানান নেতার নানান ভূমিকা আছে দলের জন্যে। ভালোমন্দ মিলিয়ে শামীম ওসমানেরও আছে। তার কারনে নারায়নগঞ্জে ত্বকী হত্যার বিচার হয়নি। অনেকের মতো তিনিও ভুলে যান এখনও মানুষ আওয়ামী লীগ করে এ দলে আসে শেখ হাসিনাকে দেখে, শেখ হাসিনার জন্যে।
শামীম ওসমানকে দেখে বা তার জন্যে লোকজন আওয়ামী লীগ করেনা। ফেসবুকে লেখালেখি করে। শামীম ওসমান নারায়নগঞ্জে এক ভাই আওয়ামী লীগ এক ভাই জাতীয় পার্টি নীতির রাজনীতির প্রবক্তা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে তিনি কানাডায় চলে যান।
এরজন্যে আইভীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। সেই থেকে নারায়নগঞ্জের মানুষকে নিয়ে তিনি ঘর-সংসারবিহীন একা। ওয়ান ওম্যান আর্মী! তাঁর স্বামী-সন্তানরা এখনও নিউজিল্যান্ডে থাকেন। ওয়েলিংটনে বেসিন রিজার্ভ মাঠে বাংলাদেশ দলের খেলা দেখতে দেখতে তাঁর স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম দেশে ফিরছেননা কেনো।
আমাকে তিনি বলেন, এখন দেশে ফিরে গেলেতো লোকে বলবে মেয়রের স্বামী সুযোগ সুবিধা নিতে এসেছে! আঠার বছর ধরে আইভী নারায়নগঞ্জের মানুষের ভোটে নির্বাচিত নেত্রী। এভাবে ধারবাহিক মানুষের ভোট পাওয়া এত সহজ নয়। কাজ দেখে ভোট দেয় মানুষ। ভালোবেসে দেয়।
ভোটটা জোর করে এক-দু’বার নেয়া সম্ভব। বা দলের জোয়ারে কলাগাছও নির্বাচিত হয়। কিন্তু শামীম ওসমান বললেও আইভীতো কোন কলাগাছ প্রার্থী নন। শেখ হাসিনা কলা গাছ প্রার্থী হিসাবে আইভীকে প্রার্থী করেননা। নারায়নগঞ্জের ভোটাররা কলাগাছ দেখে ভোট দেননা।
আইভীকে তারা কাজ দেখে বারবার ভোট দেন। এবারও ভোট দিয়েছেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসাবে আঠারো বছরের জীবনে আইভির বিরুদ্ধে বড় কোন অভিযোগ আসেনি যা তার গ্রহনযোগ্যতা বা জনপ্রিয়তায় ধস নামাতে পারে। এবার তিনি আরেকটি প্রচারনারও জবাব দিয়েছেন!
এতদিন বলা হতো নারায়নগঞ্জের সেই প্রথম সিটি নির্বাচনে তৈমূর আলম খন্দকারকে বসিয়ে দেয়ায় আইভী জিতেছিলেন। এবারতো সবাই দেখলো তৈমূর আলম খন্দকারকে হারিয়েই জয়ী হন আইভী। ভালো ফাইট দিয়েছেন তৈমূর আলম খন্দকার। তার পক্ষে আইভী বিরোধী আওয়ামী লীগারাও ছিল।
নারায়নগঞ্জের মানুষ এবারও উৎসবমুখর শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। অনেকদিন পর এমন আরেকটি নির্বাচন দেখলো দেশের মানুষ। তৈমূর আলম খন্দকারদের নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও এই নির্বাচনকে সার্টিফিকেট দিয়ে বলেছেন, এটি তাদের সর্বোত্তম নির্বাচন।
ভোটগ্রহনের সময় শেষ হবার পরও ভোটাররা লাইনে দাঁড়িয়েছিল। ভোটকেন্দ্র সীমার ভিতরের লাইনে দাঁড়ানো ভোটারদের সবার ভোট নেয়া হয়েছে।
আর আইভীর তৈমূর কাকা একজন বিএনপি নেতার মতো অভিযোগ করেই গেছেন! জাহাঙ্গীর কবির নানকরা নারায়নগঞ্জের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করলে তৈমূর আলম খন্দকার অভিযোগ করে বলেন ইলেকশন ইঞ্জিনীয়ারিং এর জন্যে এই বৈঠক!
কিন্তু ভোটের দিন বিপুল সংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহন প্রমান করেছে সেই দেখা-সাক্ষাৎ অথবা বৈঠক কোন ইঞ্জিনীয়ারিং এর জন্যে ছিলোনা। আইভীর মতো জনপ্রিয় প্রার্থীকে ভোটে জিততে কোন ইঞ্জিনীয়ারিং করা লাগেনা। শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরীদের পর দেশের আরেকজন মানুষের নেত্রীর নাম এখন ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভী।
আইভীর মনোনয়ন এবারও নারায়নগঞ্জের আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে আবার প্রকাশ্য করেছে। শেখ হাসিনার নির্দেশ-জাহাঙ্গীর কবীর নানকদের উদ্যোগও এই বিভক্তিকে প্রশমিত করতে পারেনি। শামীম ওসমানের শহরে শেখ হাসিনা আইভীর নির্বাচন সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়ে নানককে পাঠান।
বিক্ষুদ্ধ নানক বলেছিলেন জীবন থাকতে আর কোনদিন নৌকা পেতে দেবেননা! নারায়নগঞ্জের মহানগর ছাত্রলীগের কমিটিকে ভেঙ্গে দিয়ে শুরু হয় কেন্দ্রীয় একশন। সর্বশেষ স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিও ভেঙ্গে দেয়া হয়। শামীম ওসমানের জন্যে এসব একশন ছিল অভাবিত।
শুধু কমিটি ভেঙ্গে দেয়া নয়, পুলিশি একশনও শুরু হয়েছিল। পরিস্থিতি দেখে সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা। নৌকার জন্যে নামলাম ঘোষনা দিলেও আসলে তিনি কি করছেন তা প্রকাশ পেয়েছে তার কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল!
শামীম ওসমান যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন সেখানে নৌকা হেরেছে! নারায়নগঞ্জের আদর্শ স্কুল কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী আইভি পেয়েছেন ৩৬২ ভোট। আর বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার সেখানে ৬৮০ ভোট পেয়েছেন! এটা অবশ্য তৈমূর আলম খন্দকারের নিজস্ব কেন্দ্র।
ভোট করতে নেমে তিনি বিএনপির পদ হারিয়েছেন তৈমূর আলম খন্দকার। এবার আমও গেলো ছালাও গেলো। বিএনপির কর্মীরা তার সঙ্গে ছিলেন। ভোট জিতলে অবশ্য কুমিল্লার মেয়রের মতো দলে ফেরার একটি পথ হতো। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার অনিশ্চয়তার মুখে এই মুক্তিযোদ্ধা নেতার।
তৈমূর আলম খন্দকারকে ‘গড ফাদার শামীম ওসমানের প্রার্থী বলে অভিযোগ করেছিলেন আইভী। শামীম ওসমানের ভোট কেন্দ্রে নৌকার হার বিষয়টিকে আরও উস্কে দেবে। শেখ হাসিনার আশীর্বাদ হারালে আওয়ামী লীগে সবাই জিরো।
ভোটে হেরে গিয়ে তৈমূর আলম খন্দকার ইভিএমকে দুষলেন! বাংলাদেশের এই প্রবনতা দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারলোনা! এখানে কোন বিজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাননা। উল্টো নানান অভিযোগ করে তারা সেই ভোটারদের অপমান করেন যারা ম্যান্ডেট দিয়েছে।
এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনেও বিজিত দল কোন দিন বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানায়নি। এরজন্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের আন্দোলনে ভোটাদের ব্যাপক অংশগ্রহন নেই। কারন তারা সবাইকেই ক্ষমতায় দেখেছে। ক্ষমতায় গেলে কে কি করেন তা সবাই জানেন।
নাসিকের হ্যাট্রিক বিজয়ী মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভীকে অভিনন্দন। আইভীকে আবার মনোনয়ন দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা। অভিনন্দন নারায়নঞ্জের ভোটারদের। যারা দীর্ঘদিন পর দেশের মানুষকে এমন একটি অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন দেখিয়েছেন। এমন ভোটারদের নিয়ে আইভী গর্ববোধ করতেই পারেন। ‘এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি।‘
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
.....................................ওমর আলী
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,
রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।
সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো
মায়াবী উচ্ছ্বাস দুটি চোখ, তার সমস্ত শরীরে
এদেশেরই কোন এক নদীর জোয়ার বাধভাঙা;
হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে।
সে চায় ভালবাসার উপহার সন্তানের মুখ,
এক হাতে আঁতুড়ে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন,
সে তার সংসার খুব মনে-প্রাণে পছন্দ করেছে;
ঘরের লোকের মন্দ-আশংকায় সে বড় করুণ।
সাজানো-গোছানো আর সারল্যের ছবি রাশি রাশি
ফোটে তার যত্নে গড়া সংসারের আনাচে-কানাচে,
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর এ ব্যাপারে খ্যাতি;
কর্মঠ পুরুষ সেই সংসারের চতুষ্পার্শ্বে আছে।
আইভীর জীবনের সবকিছু অবশ্য এমন কবিতার মতো নয়। মানুষের বারবার ভোটে স্বীকৃতি পাওয়া এক জীবন কবিতার শিরোনাম ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভী।