প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমার নেবেনা

ফজলুল বারী

প্রকাশিত: ১৭:১৭, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমার নেবেনা

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে নতুন করে হাত পা ছুঁড়ছেন! এদের মধ্যে অনেক আওয়ামী লীগ ভালোবাসার লোক আছেন। শেখ হাসিনাকেও তারা ভালোবাসেন। এই রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুকে কেন্দ্র করে তারা শেখ হাসিনাকে মাদার অব হিউম্যানিটি খেতাবও দিয়েছেন।

এখন এই খেতাবটি তারা প্রত্যাহার বা প্রত্যাখ্যান করেছেন কী না তাও বলছেননা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ইস্যুটিতো বাচ্চা ছেলেদের ঝগড়ার ইস্যু নয় যে কোন সমাধানের পদ দেখানো ছাড়া বলতে শুরু করলাম তোমার সঙ্গে খেলবোনা আর, এই দিলাম আড়ি! বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার শিকার।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ এবার দাওয়াত করে আনেনি। আর বাংলাদেশতো কোন আকর্ষনীয় অভিবাসনের দেশও নয় যে এখানে তারা থেকে যেতে চাইছে। বাংলাদেশীরাই সারা বছর নিজেদের দেশ ছেড়ে বিভিন্ন দেশে চলে যেতে চায়। সাগর-পাহাড় ডিঙ্গায়। অথচ বাংলাদেশীদেরতো একটা দেশ আছে।

রোহিঙ্গাদের কোন দেশ নেই। তাদের দেশ-রাষ্ট্র তাদের স্বীকার করেনা। জীবনের ভয়ে তারা বাংলাদেশে এসে শরণার্থী শিবিরের বস্তির মতো ঘরগুলোয় ঘিঞ্জি অবস্থায় থাকছে। এক সময় জীবনের ভয়ে শরণার্থী হয়েছিলেন শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা। তাদের ছেলেমেয়েরা শরণার্থী শিশু হিসাবে বড় হয়েছে।

সিরিয়ার শরণার্থীদের ইউরোপ প্রথমে নিতে চায়নি। কিন্তু নৌকাডুবিতে আয়লান শিশুটির লাশ যখন উপকূলে ভেসে আসলো সেই ছবিটি ভাইরাল ছড়িয়ে পড়ার পর মানবিক ইউরোপ আর বাধা দিতে পারেনি। তখন ঢলের মতো সিরিয়ান শরণার্থীরা ইউরোপের দেশে দেশে গিয়ে ঢুকেছেন।

আর সেই সুযোগে ঢলের সঙ্গে মিশে গিয়ে চল্লিশ হাজারের বেশি বাংলাদেশী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরোপে ঢুকে যান। এরা কিন্তু অর্থনৈতিক শরণার্থী। মানবিক শরণার্থী, অর্থনৈতিক শরণার্থী সারা বছর ধরেই নানা দেশের নিয়মিত ইস্যু। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নতুন শরণার্থী সমস্যায় ইউরোপ জর্জরিত।

এক সময় চট্টগ্রাম আরাকান তথা বার্মার অন্তর্ভূক্ত ছিল। বংশপরষ্পরায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের আরাকান রাজ্যের সঙ্গে সামাজিক-সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল। বার্মা তুলনামূলক উন্নত হওয়াতে চাকরি-ব্যবসার সন্ধানে মানুষ জাহাজে করে রেঙ্গুন(আজকের ইয়াঙ্গুন) যেতেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও গিয়েছেন। লিখেছেন সমুদ্রে সাইক্লোন সহ নানা লেখা। মিয়ানমার দাবি করে আসছে এই রোহিঙ্গারা এক সময় চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে এসেছে। বাংলাদেশে যারা এসেছেন তাদের জন্ম কিন্তু মিয়ানমারে। কিন্তু মিয়ানমার তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে।

১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে আসতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর জাতিগত সংঘাতের দেশ মিয়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলমান হিসাবে তারা টিকতে পারছিল না। ২০১৭ সালে সর্বশেষ ঢলের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী ছিল।

বিএনপি-জাতীয় পার্টির আমলে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে রোহিঙ্গাদের সীমান্তে অভ্যর্থনা করা হয়। কিন্তু তখন পর্যন্ত আসা চালাক চতুর রোহিঙ্গাদের কেউ বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে পড়ে থাকেননি। নানান কায়দায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলে গেছেন।

কেউ গেছেন সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধ পথে। কেউ বিমান বন্দর অতিক্রম করেছেন বাংলাদেশী পাসপোর্টে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবস্থা যেহেতু দুর্নীতিগ্রস্ত তাই তারা টাকায় পাসপোর্ট করতে পেরেছেন। কিন্তু ইউরোপের দেশে ঢুকতে পারলেই তারা এই পাসপোর্ট ফেলে দিয়েছেন।

কারন রোহিঙ্গা হিসাবে ইউরোপের দেশগুলোয় ঢুকতে পারলেই তারা রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে গেছেন। এটা বাংলাদেশী পরিচয়ে আশ্রয় পাওয়া সহজ হত না। কারন ইউরোপও জানে রোহিঙ্গাদের দেশ নেই। তাদের রাষ্ট্র তাদেরকে স্বীকার করেনা। তারাই প্রকৃত শরণার্থী।

এখন অস্ট্রেলিয়ায় যত রোহিঙ্গা শরণার্থী আছেন, তারা সবাই বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া থেকে সাগরপথে এরা এসে ঢুকেছেন অস্ট্রেলিয়ার জলসীমায়। অস্ট্রেলিয়ানদের ভাষায় বোট পিপল। পিপল স্মাগলিং। অবৈধপথে অস্ট্রেলিয়ায় ঢোকায় এদের প্রাথমিক ঠিকানা হয় জেলখানা।

অন্য দেশের হলে এদের তারা বিমানে তুলে দিয়ে ডিপোর্ট করতো। কিন্তু এদের ডিপোর্ট করবে কোথায়। এদেরতো দেশ নেই। বাংলাদেশে যে ডিপোর্ট করবে সে প্রমানও নেই। এদেশে আবার জেলখানা খুব ব্যয়বহুল। খাওয়া-জিম-সুইমিং-লাইব্রেরি-কম্পিউটার-ডাক্তার-দোভাষী ছাড়াও সপ্তাহে হাতখরচও দিতে হয়।

এরজন্যে এদেরকে তারা অনিশ্চিত কতদিন জেলখানায় রেখে খাওয়াবে পরাবে। সেজন্যে তাদেরকে কমিউনিটি রিলিজে ছেড়ে দিয়েছে। খাও বাবারা কাজ করে খাও। এদের যখন মুক্ত পরিবেশে প্রথম দেখি তখন বেশ মলিন চেহারা। এখন তারা প্রায় সবাই ফ্যাশন-দুরস্ত উজ্জ্বল সব মানুষ। ভালো পরিবেশে থাকলে যা হয়। অনেকে এখনও মুখ লাল করে পানও খান।

২০১৭ সালের রোহিঙ্গা ঢলের সময় বাংলাদেশ প্রথমে তাদের গ্রহন করতে চায়নি। কিন্তু আয়লানের মতো নৌকাডুবিতে যখন রোহিঙ্গা নারী-শিশুর লাশ ভেসে আসছিল তখন আর বাধা দিতে পারেনি। আরেক কারন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র স্ত্রী পেপি কিভিনিয়ামি সিদ্দিক।

অনেকে হয়তো জানেন পেপি সিদ্দিক জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের(আইওএম) ঢাকা অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তা। সীমান্তে তিনি তখন এসব মরণাপন্ন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহন করছিলেন। তখন মিডিয়ায় এসব শরণার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন ছবিতে পেপিকে দেখা যেত।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন এই শরণার্থী আশ্রয়ের পুরো কৃ্তিত্ব তাঁর বোন, পেপি’র শাশুড়ি শেখ রেহানাকে দিয়েছেন। মিডিয়াকে তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, রেহানা তাকে বলেছেন তিনি দেশের ষোল কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারেন, এই কয়েক লাখ শরণার্থীকেও খাওয়াতে পারবেন।

এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ায় তখন দেশেবিদেশে বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনা প্রশংসিত নাম। শেখ হাসিনার খেতাব হয় মাদার অব হিউম্যানিটি। শেখ হাসিনা তখন এমন সব আন্তর্জাতিক ফোরামে দাওয়াত পেতে থাকেন যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই প্রথম।

কিন্তু দিনে দিনে বাংলাদেশ বুঝতে পারে এটি তাদের ঘাড়ে সওয়ার বড় একটি বোঝা। ছোট্ট সেই জায়গায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরকে কেন্দ্র করে গোটা এলাকার পরিবেশ-জীব বৈচিত্র ধংস হয়ে গেছে। ভারত-চীন-রাশিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষ নেয়নি। এর বড় কারন ব্যবসা।

ভারতে এখন ইন্দিরা গান্ধী বা জ্যোতি বসুর মতো কোন নেতাও নেই। এই ভারত নেতৃত্ব হিন্দুত্ববাদী। রোহিঙ্গা ঢলের সঙ্গে যে সব হিন্দু রোহিঙ্গা চলে এসেছিল তাদেরকে দিল্লী আবার মিয়ানমারের বাড়িঘরে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছে। আর মুসলিম রোহিঙ্গা যারা ভারতে গিয়েছিল তাদেরকে চুপচাপ গছিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে।

বাংলাদেশের সঙ্গে টেবিলটকে ভারতের পক্ষে বলা হয় রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত মিয়ানমারের বিপক্ষে অবস্থান নিলে দেশটি চায়না গ্রিপে আরও বেশি ঢুকে পড়বে । জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যখনই রোহিঙ্গা ইস্যু উঠেছে তখনও ভেটো দিয়েছে চীন-রাশিয়া। বাংলাদেশ এ ইস্যুতে একা।

ওআইসি, মুসলিম দেশ কারও রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোন ভূমিকা নেই। আসলে মুসলমানরা শরণার্থী হিসাবে আরেক অমুসলিম দেশে আশ্রয় নিতে ভালোবাসে। মুসলমান শরণার্থী জাত তারা দেখতে পারেননা। মধ্যপ্রাচ্যে যারা ফিলিস্তিনিদের দেখেছেন তারা এটি আঁচ করতে পারেন।

বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের একজনকেও পাকিস্তান ফেরত নেয়নি। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ তাদেরকে আত্মীকরন করে নিয়েছে। রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেবার জন্যে মিয়ানমার বিতাড়ন করেনি। এরজন্যে বাংলাদেশ কী তাদের পিটিয়ে সাগরে ভাসিয়ে দিতে পারবে? নিশ্চয় নয়।

বাংলাদেশের লোকজন চায় না তারা এখানে থাকুক। আবার এরা যখন বৈধ-অবৈধপথে চলে যেতে চায় তখন তাদের পথ আটকায়! কি দারুন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড! বাংলাদেশীরা যখন বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নেয় তখন নানান মানবিক সুযোগ সুবিধা চায়। বড় চাওয়াটা হলো আনলিমিটেড কাজের সুবিধা।

কারন বিদেশে শরণার্থী মর্যাদা পেতে আশ্রয়ের আবেদনের সঙ্গে সঙ্গে কাজের অনুমতি-ফ্রি চিকিৎসা, ব্যাংক একাউন্ট খোলা-ফোন নেয়া সহ নানান সাধারন অধিকারের সুযোগ মেলে। অনেকে তখন থেকেই বাড়িতে টাকা পাঠাতে শুরু করেন। রেমিট্যান্স কিন্তু এরাই পাঠায়।

আর রেমিট্যান্সখোর পরিবারের সদস্যরাই রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে সমুদ্র সৈকতে দেখলেই চিৎকার-চেঁচামিচি শুরু করে দেন! এরপর আবার হিসাব নিয়ে বসেন রোহিঙ্গা বাচ্চা কয়টা জন্ম হলো! আসার সময় সংখ্যা কত ছিল আর এখন কত? যাদের কোন কাজ নেই তারা বাচ্চা পয়দা ছাড়া আর কী করবে?

শেখ হাসিনা জানেন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত নেবেনা। এরজন্যে তাদেরকে ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু করেছেন। ভাসানচরেও এরা থাকবেনা। হঠাৎ হঠাৎ জানা যাবে অমুক নেই অমুক নেই! সাগরপথে তারা থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা করবে। জীবনে যাদের কোন আশা নেই তাদের আবার সাগরে ডুবে মরার কী ভয়!