প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

"ঠিকানা"

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক

প্রকাশিত: ০০:৩৭, ১ জুলাই ২০২১

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক

মস্কোতে পড়াশোনা করার সময়, যেসব বিষয়ে ছাত্র ছাত্রীরা বেশ উৎসাহ বোধ করত, তা হলো, নিজের বিষয় অনুসারে প্রাকটিক্যাল করা

সমস্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দুইটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম বিশেষভাবে আলোচিত ছিল।একটি হলো মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি, দ্বিতীয়টি হল মস্কো পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট।

কারণ এখানকার পড়াশোনার মান, শিক্ষকদের তদারকি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, সর্বোপরি এইসব প্রতিষ্ঠানে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী, এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও অধ্যাপনা করতেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ,বড় বড় বিজ্ঞানী, বিখ্যাত অধ্যাপক, অধ্যাপনা করতেন, শিক্ষার মানও সমান ছিল।

চতুর্থ বর্ষ শেষ করার পরে আমাদের বিষয় অনুযায়ী একটি বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে, প্রাক্টিক্যাল করার জন্য নির্বাচিত হলাম।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে প্রাক্টিক্যাল খুবই আনন্দদায়ক হয়।ছেলে-মেয়ে সবাই একত্রে আমরা প্রাক্টিক্যাল করতে পারি, যে প্রতিষ্ঠানে আমরা প্র্যাকটিক্যাল করতে যাই, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা খুবই খাতির যত্ন করে, এবং প্রাকটিকালে সাহায্য-সহযোগিতা করে। চার থেকে পাঁচজন করে শিক্ষার্থী নিয়ে, একটা গ্রুপ গঠিত হয়।

আমাদের বিদেশী ছাত্রদের একটি প্রবণতা ছিল, রাশিয়ান শিক্ষার্থীদের সাথে একই গ্রুপে প্রাক্টিক্যাল করার,আগেই বলে রাখি সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে যেকোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সমান সমান থাকতো। আমার বাঙালি বন্ধুরা, আমি সহ সবাই চাইতাম কোন রাশিয়ান গ্রুপে, যে গ্রুপে কমপক্ষে দুই,তিন জন ছাত্রী আছে। কারণ ছাত্রী বন্ধুরা বিদেশি বন্ধুদের উপর বিশেষ সহানুভূতিশীল হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের শিক্ষকদের কথা কিছু বলতেই হয়। আমরা প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করে শেষ বর্ষ অবধি, বাড়ির কথা ভুলেই যেতাম, আমাদের শিক্ষক শিক্ষিকাদের মানবিক আচরণের কারণে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যারা পড়াশোনা করেছেন, আমার মনে হয় না, কোন মানুষ তাদের প্রথম রাশিয়ান ভাষার শিক্ষক বা শিক্ষিকা, ইতিহাস ও ফিলোসফি বিভাগের শিক্ষকদের কোনদিন ভুলে যেতে পারবেন।

চতুর্থ বর্ষ শেষে, মেট্রো সলকোভস্কায় ২৩ নম্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে, প্রাক্টিক্যাল আরম্ভ করলাম। আমাদের গাইড ছিলেন, আমাদেরই একজন প্রবীণ বিদূষী অধ্যাপিকা এলেরোনা কারপভনা।

আমরা যথারীতি আনন্দ উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রাক্টিক্যাল আরম্ভ করলাম। আমি যে গ্রুপে পড়লাম সেই গ্রুপে দুই জন ছাত্রী ও একজন ছাত্র, সবাই রাশিয়ান। সবার সাথেই আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল, হাসি-ঠাট্টা চলত সাথে, সাথে প্রাক্টিক্যাল। মাঝেমধ্যে আমাদের গাইড এলেরোনা কারপভনার শ্নেহ মিশ্রিত কঠোর তদারকিও চলত। আমি স্বভাবগতভাবেই সব সময় হাসি, খুশি আনন্দ-ফুর্তি করতাম। বন্ধু বান্ধবীদের সাথে একেবারেই আন্তরিকতার সাথে অন্তরঙ্গভাবে মিশতাম। নানান হাসি-ঠাট্টা চলত দুই বান্ধবীই বলতো, আমি তাদের বিশেষ বিশেষ আকর্ষণীয় বন্ধু। এলেরোনা কারপভনা আমাদের এইসব নিষ্পাপ হাসি ঠাট্টা দেখে মনে মনে আনন্দ পেতেন। অন্য গ্রুপের এক মেয়ে একদিন রসিকতা করে বললেন, সোভিয়েত ইউনিয়নে সতীনের ঘর করার কোনো উদাহরণ নাই, তোমরা দুজনের একজন সাবধান হও। এই ধরনের নানান হাসি-ঠাট্টা চলত।

সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম ক্লাস থেকেই আমাকে "রাজ" নামে ডাকা হতো। যেদিন আমরা প্রথম ভর্তি হই, তখন আমার নাম রাজ্জাক এটা উচ্চারণ করতে আমাদের যে ভর্তি করিয়েছেন, তার দাঁত প্রায় নড়বড়ে অবস্থা হয়ে গিয়েছিল।পাঁচ থেকে ছয় বার চেষ্টা করেও পুরো, "রাজ্জাক" নামটি উচ্চারণ করতে পারেন নাই। তাই প্রথম দিনেই আমার নাম হয়েছিল "রাজ"। রাজ নামটি যে কেউ সহজে উচ্চারণ করতে পারে।

সোভিয়েত ইউনিয়নে একটা ব্যাপার ছিল, কে কোন ধর্মের, কার জাতিভেদ কি, এসব একেবারেই অনুজ্জ্ব থাকতো।

হয়তো নামের কারণে ধারণা করা যেত, কে কোন ধর্মের। আমার নামটা রাজ হওয়ায় খুবই মুশকিল হতো আমি কোন ধর্মের সেটা নির্ধারণ করা। এরকম আরো আছে যেমন কাজল, মুকুল, লিটন। ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমাদের দেশে আমরা নাম দিয়েই অনেক কিছু বিচার বিশ্লেষণ করি। যেমন আমার দুই বন্ধু ছিল, শম্ভু ও লিটন। যখন আমরা ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি বাংলাদেশ থেকে এক বয়স্ক মহিলা কোন একটা কনফারেন্সে দুই সপ্তার জন্য মস্কো গিয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা ছিলেন খুবই ধার্মিক। আমরা তিনজন ভদ্রমহিলাকে সাহায্য করার জন্য ভদ্রমহিলার সাথে কিছুক্ষণ থাকলাম। বিকেলে ভদ্রমহিলা আমাকে ও শম্ভুকে খুবই বিনয়ের সাথে বললেন, বাবা তোমরা দুইজন যাও, লিটন তুমি কিছুক্ষণ আমার সাথে থাকলে আমার সুবিধা হবে। আমরা চলে আসার পরে ভদ্রমহিলা লিটনকে বললেন, বাবা আমি ওজু করে নামাজ পড়বো। তুমি আমাকে হালাল খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবে। তুমি তো মুসলমান, তুমি সব বুঝবে, শম্ভু রাজ ওরা তো অন্য ধর্মের, তাই ওরা না থাকাই ভালো।

আসল সত্য হলো, লিটনের সম্পূর্ণ নাম, লিটন কুমার সাহা, সম্ভুর সম্পূর্ণ নাম, মোঃ জুলফিকার রহমান সম্ভু। আমার নামতো বুঝতেই পারছেন। কপাল ভালো, আমরা দুইজন বা লিটন সম্পূর্ণ নামটা ভদ্রমহিলার সামনে উচ্চারণ করি নাই।

আমাদের প্রাকটিক্যাল করার মাঝামাঝি সময়ে, আমার এক বন্ধুর চিঠির মাধ্যমে আমি জানতে পারলাম, আমার বাবা মারা গিয়েছেন, তাও প্রায় এক বছর আগে। আমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে আমাকে আগে জানানো হয়নি।

এই সংবাদ শোনার পরে নিজের ভিতরটা যে কিরকম দগ্ধ হতে লাগলো, সেটা আপনারা বুঝে নিবেন।

সব সময় মনে হতে লাগলো, বাড়িতে ছোট চারটা বোনের কথা, ছোটো দুইটি ভাই ও মায়ের কথা। সবাই বয়সে আমার অনেক ছোট তাদের অসহায়ত্বের কথা ভেবে। খুবই ভেঙে পড়েছিলাম। দু'দিন সাপ্তাহিক ছুটির পরে, প্রাকটিক্যাল করতে গেলাম খুবই মনমরা অবস্থায় কোনরকমে গ্রুপের সাথে কাজ আরম্ভ করলাম। প্রথম এক ঘন্টা পরে এলেরোনা কারপভনা, আমার কাছে এসে পিঠে হাত দিয়ে কানের কাছে আস্তে করে বললেন, রাজ তুমি বিমর্ষ কেন?

আমি মনে মনে ভাবলাম আমি বোধহয় আমার কাজটি ঠিকমতো করতেছিনা, আমি ক্ষীণস্বরে বললাম, কিছু না, এমনি আরকি, আমি কাজে মন দিচ্ছি। যতই কাজ করার অভিনয় করি না কেন, হয়তো আমার মধ্যে কোন জড়তা ছিল। কিছুক্ষণ পরে এলেরোনা কারপভনা আবার এলেন বললেন, রাজ তুমি কাজ ঠিকই করছো, আমার মনে হচ্ছে তোমার বুকের মধ্যে কি যেন লুকায়িত আছে। আমি কোন কিছু বুঝতে না দিয়ে, আবার কাজ আরম্ভ করলাম।

বিরতির সময় এলেরোনা কারসভনা আমাকে পাশে ডেকে নিলেন , বললেন, পুত্র তুমি আমার কাছে লুকাচ্ছো কেন? আমিও যে সন্তানের মা, মা সন্তানের মনের কথা বুঝতে পারে, তুমি হয়তো বাড়ি থেকে খারাপ কোন সংবাদ পেয়েছো, দেশে তোমার নিশ্চয়ই কোন একটা কিছু ঘটেছে। নিঃসংকোচে আমার কাছে বল। আমি খানিক ইতস্তত করে মাটির দিকে মাথা নিচু করে, আমার পিতৃবিয়োগের কথা বললাম।

ভদ্রমহিলা বললেন আমি বুঝেছি তোমার মনের অবস্থা।

বললেন,তুমি কিছু ফুল কিনে, তোমার ইচ্ছামত তোমার দেশের রীতি অনুসারে কোন জায়গায় অর্পণ করো অথবা তোমাদের রীতি অনুসারে কোন স্থানে গিয়ে তোমার বাবার বিদেহী আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করো। দেখবা তোমার বুক হালকা হয়ে যাবে, তুমি এই দুঃখ বেদনা থেকে মুক্ত হবা।

এলেরোনা কারপভনা, আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, পুত্র শোনো,তুমি মনে করো তোমার মায়ের পাঁচটি সন্তান, একজন থাকে আমেরিকায়, একজন থাকে জার্মানিতে, একজন ইংল্যান্ডে, একজন রাশিয়ায়, অন্যজন থাকে সৌদি আরবে। তোমরা পাঁচ ভাই চিঠি লেখ, তোমার মায়ের কাছে, তোমার পাঁচ ভাইয়ের ঠিকানা কিন্তু একটিই, এই পাঁচটি চিঠি একই ঠিকানায় পৌঁছাবে, যদিও চিঠিগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, তোমার মায়ের ঠিকানায় লিখা।

বললেন শোনো, মুসলমানরা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে বলে আল্লাহ, হিন্দুরা বলে ভগবান, খ্রীস্টানরা বলে গড, কিন্তু সবার প্রার্থনার ঠিকানা একটাই।

সেই রকম তুমি যে ধর্মের, যে জাতি গোষ্ঠীর, হওনা কেন, তোমার দুঃখ লাঘবের জন্য, তোমার পিতার শান্তির জন্য, মন থেকে যদি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করো, তবে একই ঠিকানায় সেই শ্রদ্ধাঞ্জলি পৌঁছে যাবে, তোমার আব্বার আত্মা শান্তিতে থাকবে।

আমি প্রিয় শিক্ষিকা, এলেরোনা কারপভনার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার দুটি চোখে অশ্রুবিন্দু, তার চোখের দিকে আমার চোখ পড়তেই বলল, পুত্র, তুমি আজ বিকেলে তোমার ইচ্ছামত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করো।

বিদূষী মহিলার মুখের সাথে কেন জানি, আমার মায়ের মুখের প্রতিচ্ছবি, সবচেয়ে প্রিয় জনের মুখের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম।

প্রিয় শিক্ষিকা, এলেরোনা কারপভনা আমার ধর্মের বা জাতির কোনো পরিচয় জিজ্ঞেস না করেই, আমাকে শিক্ষা দিয়ে দিলেন, সকল ধর্মের সকল জাতির প্রার্থনা, অঞ্চল, সমাজ ভেদে, বিভিন্ন ধরনের হলেও, গন্তব্যের

ঠিকানা একই জায়গায়।

(বিঃ দ্রঃ সোভিয়েত ইউনিয়নে আমরা শিক্ষকদের পূর্ণ নাম ধরে ডাকতাম)