প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

"ইতি, আপনার স্নেহের আবু মিয়া"

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক

প্রকাশিত: ০০:০০, ১ জুলাই ২০২১

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক

"ইতি, আপনার স্নেহের আবু মিয়া"

প্রায়ই বিকেল বেলা পুকুরের উত্তর পাশে ঘাটলা বাঁধানো পাড়ে বড় চাচার সাথে বসে থাকতাম, ডাক পিয়ন একটি মানি অর্ডার নিয়ে আসলো, টাকার অংক দশ।

বড় চাচা আনমনা ভাবে স্মৃতিকাতর হয়ে গেলেন। স্মৃতি থেকে কিছু কথা আপন মনে বলে চললেন, কথাগুলো আজও আমার অন্তরে ভাসে।

১৯১৮ সালে বড় চাচা শিক্ষকতা করার উদ্দেশ্যে আমাদের বাড়ি বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার চাউলাকাঠী গ্রাম থেকে, প্রায় আশি মাইল দূরে বরগুনা থানার কাকচিড়া গ্রামের জমাদ্দার বাড়িতে শিক্ষকতা শুরু করেন। এই সময় আমার বড় চাচা মৌলভী ইসমাইল মাস্টার, ওই বাড়িতে মক্তব খোলার পর ওই গ্রামের প্রায় সব মানুষই চাচার কাছে পড়তে আসতেন। আমার চাচার কোন সনদপত্র ছিল না। চাচা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বানারীপাড়া স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু আমার চাচা ইংরেজি বাংলা আরবিসহ সব বিষয়ই পাঠ দান করতেন। বিশেষ করে গণিতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। আমি ছোটবেলায় দেখেছি ঐকিক নিয়ম ও সুধকষা অংকের ফলাফল মুখেমুখে হিসাব করে বলে দিতে পারতেন। চাচাকে সেই সময়ে ব্রিটিশ সরকার জিটি পাশের সনদপত্র প্রদান করেন। জিটি পাসের অর্থ হল গুরু ট্রেনিং পাস। সরকার থেকে কোন অনুদান পেতেন না, গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে যা কিছু দিতেন সেটাই ছিল চাচার একমাত্র উপার্জন। ওই সময় টাকাপয়সা খুব একটা দিতে পারতেন না। তবে আমন ধান ওঠার সময় সকল বাড়ি থেকে যে পরিমাণ ধান দিতেন সেই ধান থেকেই বছরের খাবার হয়ে যেত। এমনকি পাঁচ থেকে দশ মণ ধান বিক্রি করে অন্যান্য যাবতীয় খরচ মেটানো যেত।

এক বাড়িতে চুয়াল্লিশ বছর শিক্ষকতা করার পরে ১৯৬২ সালে আবার বাড়িতে চলে আসেন। আমাদের গ্রামেই একটি মক্তব খুলে পুনরায় শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। এটাকে ছোটখাটো মাদ্রাসা বলতে পারেন। কোরআন শিক্ষাসহ সকল বিষয়ে পড়াতেন।

দশটি টাকা পাওয়ার পরে চাচা বললেন, ওই জমাদ্দার বাড়িতে আমার ৪৪ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তিন পুরুষকে পড়িয়েছি, এখনো ওই বাড়ির ওই গ্রামের মানুষজন আমাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণে রেখেছে এই জন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া।

দশটি টাকা পাওয়ার পরে চাচা খুশির চেয়ে, আত্মহারা বেশি হয়েছিলেন, চাচার স্বনামধন্য ছাত্র পুলিশ বিভাগের বড় কর্মকর্তা এই কথা মনে করে। দশটি টাকা যে পাঠিয়েছেন, সেই ব্যক্তি পুলিশ বিভাগে কিছুদিন আগে ডিএসপি হিসেবে কাজে যোগদান করেছেন। এই পুলিশ অফিসার তার সেই প্রথম জীবনের শিক্ষাগুরুরকে ভুলিতে পারেন নাই।

আমার কাছে চাচা বলে গেলেন, আমার ছাত্রের নাম আবু মিয়া বড় হয়ে তার সাথে দেখা করবি, তোকে হয়তো ছোটবেলায় দেখেছে, পূর্ব পরিচয় দিলে হয়তো অনেক উপকার আসবেন।

এই কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিছুদিন আগে বৃষ্টির মধ্যে একটি হলুদ রঙের গাড়ি ভাড়া করে আমার এক বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি। বয়স্ক দাড়িওয়ালা ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বাড়ি কোথায়, ড্রাইভার সাহেব বললেন বরগুনা, জিজ্ঞেস করলাম কোন গ্রামে? ড্রাইভার সাহেব বললেন, কাকচিরা গ্রামে।

বললাম জমাদ্দার বাড়ি চিনেন, উত্তর দিলেন, আমাদের পাশের বাড়ি খুবই অবস্থাসম্পন্ন বাড়ি ওই বাড়ির সবাইকে চিনি। বললাম আবু মিয়া পুলিশ অফিসার সাহেবকে চিনেন কিনা।

কারণ এর আগে আমার এক বন্ধু পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন, তার কাছে শুনেছিলাম আবু মিয়া নামে পুলিশের কোন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আছেন কিনা, যিনি বিসিএস পাশ করে ডিএসপি হিসেবে চাকরি আরম্ভ করেছিলেন। আমার বন্ধু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওই নামে কোন পুলিশ অফিসারের সন্ধান পাননি।

ড্রাইভার সব বললেন আবু মিয়াকে চিনি, উনি বনশ্রী মসজিদের পশ্চিম পাশের বাড়িতে থাকেন, তবে তার নাম, মাহমুদ শাহজাহান। আমি কাজ সেরে ওই দিন সন্ধার পরে আবু মিয়া সাহেবের বাসায় গেলাম, পরিচয় দেওয়ার পরে সে চিনতে পারলেন। অবসর জীবনে আবু মিয়া সাহেব খুবই ধার্মিক মানুষ তাবলীগ জামাত করেন। আবু মিয়াকে আমি খুলে বললাম, আপনার এই নামে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি, আজ এক ড্রাইভার এর মাধ্যমে আপনার সঠিক পরিচয় পেয়ে আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী হলাম। আমার বড় চাচা মারা গিয়েছেন প্রায় ৩০ বছর আগে, বড় চাচাকে পাঠানো আপনার সেই প্রতিমাসে দশটি টাকা, আমার বড় চাচা সারা জীবন মনে রেখেছিলেন।

মানি অর্ডারের কাগজের শেষ প্রান্তে ছোট করে লেখা থাকতো, ইতি আপনার স্নেহের আবু মিয়া।

আপনি বড় পুলিশ অফিসার হয়েও আপনার সেই ছোটবেলার শিক্ষক, মৌলভী ইসমাইল মাস্টারকে ভুলেন নাই, সেই জন্যই আপনাকে দেখতে আসলাম। আবু মিয়া আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের পানি ছেড়ে বললেন, মিয়াছাব শুধু কি শিক্ষক, উনি ছিলেন অভিভাবকের মতো, উনার কাছ থেকে যা কিছু শিখে ছিলাম সেটাকে সম্বল করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে পরবর্তীতে পুলিশ সার্ভিস ৩০ বছর চাকরি করেছি। আমি এখনো মিয়াছাবের নামে বছরে মিলাদ দেই, উনার জন্য সব সময় দোয়া করি। তোমাদের বাড়ি নদীতে ভেঙে যাওয়ার কারণে, মিয়াছাব মারা যাওয়ার কারণে কোন যোগাযোগ নাই, কিন্তু মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত মিয়াছাবকে আমি ওস্তাদ মানিব।

আবু মিয়া সাহেবের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরে গাড়িতে বসে চিন্তা করতে ছিলাম, সেই সময়কার শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্ক আর আজকের সময়ের সম্পর্ক কত ব্যবধান।

ইট কাঠ পাথরের বড় বড় অট্টালিকা, যাতায়াত ব্যবস্থার কত উন্নতি, টেলিভিশন কম্পিউটার মোবাইল কতকি, সহজ করে দিয়েছে জীবন ব্যবস্থা। শুধু হৃদয়কে করেছে সংকোচিত ।

এখন আর নিজের জীবনের প্রথম ইনকাম থেকে দশটি টাকা মানি অর্ডার করে কেউ শিক্ষককে লিখেনা, "ইতি আপনার স্নেহের আবু মিয়া।"

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক।

২৫/০৬/২১

লেখাটি যে কেউ শেয়ার করতে পারেন।