প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

"মেধাবী সেই ছেলেটি"

Razzak Abdur

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ৩০ জুন ২০২১

Razzak Abdur

"মেধাবী সেই ছেলেটি"

২০১৭ সালের এপ্রিল-মে মাসের দিকের ঘটনা। আমি, সাথে একজন সঙ্গী নিয়ে আমার এলাকার বিভিন্ন গ্রামে, কখনো পায়ে হেঁটে কখনো ভ্যানে বা কখনো রিকশায় করে প্রতিটি পাড়া-মহল্লা গ্রাম ইউনিয়নে ভ্রমন করতেছি। আমার নিজের ইউনিয়ন এর বাইরে অন্য একটি ইউনিয়নের একটি বাজারে একটি চায়ের দোকানে বসে চা বিস্কুট খাচ্ছি। ইচ্ছে করেই ওই দোকানে ঢুকলাম, যে দোকানে ১৫-২০ জন মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছে। বেলা তখন সাড়ে এগারোটা কি বারোটা বাজে। সবার জামা কাপড় কথাবার্তা শুনে মনে হল শিক্ষিত মানুষ সবাই। নির্দিষ্ট কোন পেশায় নিয়োজিত।

আমার পরনে লুঙ্গি, গায়ে হাফ শার্ট, হাতে একটি ফোল্ডিং ছাতা। সবার কথাই শুনছি, ইলেকশন নিয়ে কথা হচ্ছে। আগামী ইলেকশন সম্পর্কে বিভিন্ন কথা, কে নমিনেশন পেতে পারে, কোন পার্টি ক্ষমতায় আসবে, অত্র এলাকায় ভালো, মন্দ মানুষ কে?, এলাকার উন্নয়ন ও মানুষের মঙ্গল কে বেশি করতে পারবে? এইসব নিয়েই আলোচনা।

এই ঘটনার আগে আমার কিছু পোস্টার এলাকায় সাটা হয়েছিল সেখানে আমার ছবি ছিল টাই কোট পরা। লুঙ্গি পরা অবস্থায় আমাকে কেউ চিনতে পারলো না। একপর্যায়ে আমার নামটাও ক্ষীণ আলোচনায় এলো। দু'একজন বললো শুনেছি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বিদেশে পড়াশোনা করেছে, মানুষ হিসেবেও নাকি ভালো, তবে উনার পরিচিতি খুবই কম।

এমন সময় আমার সাথী, বলে বসলো, এইতো রাজ্জাক ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। সবাই আমার সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসলো। আমি দু চার কথা বললাম আমার পরিচয় দিলাম। চা খাওয়ার শেষ সময় একজন ভদ্রলোক এসে আমার কাছে বলল, স্যার আমাকে কি চিনতে পেরেছেন?। আমি বললাম আমি সাধারণত কোন মানুষকে একবার দেখলে অনেকদিন মনে রাখতে পারি, আপনাকে আমি দেখছি বলে মনে হয় না। ভদ্রলোক বললেন, আমাকে আপনি বহুবার দেখেছেন আপনার অফিসে ও বাসায়। আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো এইরকম স্মৃতিভ্রম আমার তো হওয়ার কথা না। খুবই চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার কি স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে?। ভদ্রলোক বললেন স্যার আপনার কোন দোষ নাই আমার চেহারার আমূল পরিবর্তন হয়েছে আমার এই লাল চুল বাদ দিয়ে অভয়বের এই পরিবর্তন বাদ দিয়ে চিন্তা করুন আমাকে চিনতে পারবেন। ভদ্রলোক বললো, স্যার আপনার টেলিফোন নম্বর দেন আমি আপনার কাছে টেলিফোনে সব বলবো।

আমার খুবই প্রিয়, কাস্টম সার্ভিসের আলী আহমেদ সাহেব, আমার সাথে সম্পর্ক ছোট ভাই বড় ভাইয়ের মতো। একদিন আলী আহমেদ সাহেব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আমাকে ডেকে পাঠালেন বললেন রাজ্জাক, তুমি কি ২৫ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারবে, যদি পারো তাহলে আমরা একটা মহৎ কাজ করি। এটা ১৯৯৮ সালের কথা। বললাম ভাই ২৫ হাজার টাকা কোন ব্যাপার না, তবে কাজের কথাটা বলেন, বললেন তুমি অনেকদিন বিদেশে, আমাদের অঞ্চলের একটা ছেলে নাম শাহিন সে বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়েছে,ছেলেটি খুবই গরীব যদি পারো এই টাকাটা জোগাড় করো, মাসে এক হাজার করে ওকে টাকা দিলে, ওর পড়াশোনাটা ভালো ভাবে চালিয়ে নিতে পারবে।

যে কথা সেই কাজ আমরা টাকা যোগাড় করলাম শাহীনকে ডেকে আমরা প্রথমে এক হাজার টাকা দিলাম।মনটা খুব ভরে গেল এরকম ইউনিভার্সিটি পড়ার সময় প্রতি মাসে এক হাজার টাকা পাওয়া কতযে সৌভাগ্যের ব্যাপার, আমি চলে গেলাম ১৫ বছর আগের আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষে। ছেলেটা আমার বাসায় আসে, অফিসে আসে, মাঝে মাঝে কথা বলি। ওকে একটা কথা বললাম বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় ক্যাম্পাস এখানে নিজের জীবন নিজেই গড়ে নিতে হয় নিজের বন্ধুবান্ধব, চলাফেরার স্থান তুমি সাবধানে সিলেক্ট করবা, গরিব ঘরের ছেলে কোনরকম বিচ্যুতি যেন না হয়। কিছুদিন পরে আমি একটি ভালো দোকান থেকে ওকে প্যান্ট শার্ট কিনে দিলাম ক্যালকুলেটর সহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে দিলাম। ছয় মাস পরে শুনলাম ও প্রথম সেমিস্টারে ওর বিভাগে প্রথম হয়েছে। খুশিতে মনটা ভরে গেল। আলী আহাম্মদ ভাইয়ের কাছে বললাম, আলী আহমেদ ভাই খুশিতে একেবারে আত্মহারা। বলল রাজ্জাক, আমাদের শ্রম সার্থক হতে চলেছে, যদি তিন বছর আমরা ওকে এভাবে সাহায্য করি তারপর ও নিজের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারবে। আমাদের অঞ্চলের একটি ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। আমরা দুজনেই আমাদের শিক্ষা জীবনের পিছনের কথা ভেবে কিছুটা বিমর্ষ হয়ে, আবার সুখ অনুভব করলাম।

সাত-আট মাস পর থেকে শাহিনের কোন খবর নাই আলী মাহমেদ ভাইয়ের কাছে আমি শুনলাম, শাহিনের খবর কি? বললেন, জানিনা তবে বোধহয় ভালো কোন টিউশনি পেয়েছে, ভালো আছে, ভালো না থাকলে তো আমাদের কাছে আসতো। মনে মনে খুশি হলাম শাহিন মানুষ হোক। বছর গেল দুই বছর পরে আবার আলী আহমদ ভাইয়ের সাথে ওর ব্যাপারে কথা হল, আলী আহমেদ ভাই বললেন, ওর ব্যাপারে কিছুই জানিনা তবে শুনেছি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই, কোথায় গেছে কেউ জানেনা।তারপরে মাঝে মাঝে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু আর কোনো হদিস করতে পারিনি। আমি ও আলী আহমেদ ভাই ,শাহিনকে ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি এবং আলী আহমেদ ভাই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে একটি মেধার অপমৃত্যু হয়েছে।

দোকানে বসা অবস্থায় মাথায় মেহেদী মাখা লাল চুলের ভদ্রলোককে চিনতে পারলাম।প্রথম জীবনের শাহিনের চেহারা স্মৃতি পটে ভেসে উঠলো, আমি জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম কি শাহিন ? হাঁ সূচক উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে, আমি ফোল্ডিং ছাতা দিয়ে এক বারি মারলাম।শাহিন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো বলল, আমি নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলাম, আমার এই অবস্থা ও শিক্ষা পাওনা ছিল। ওকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম এখন কি কর? বলল, এইচএসসি পাস করার সনদ নিয়ে এই চাকরি করি। এখানে উপস্থিত সবাই আমার সহকর্মী। উপস্থিত সবাই আমার পরিচয় জানল।অবিকাশিত মেধাবী মানুষকে ফেলে, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে, পরবর্তী গন্তব্যে যাত্রা শুরু করলাম ।

শাহিনের অবস্থার কথা বিবেচনা করে এখনকার ছাত্র ছাত্রীরা, শাহিনের জীবন থেকে শিক্ষা নিবে কি?

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক

৩০/০৬/২০

আজকের গল্পটি, শ্রদ্বীয় আলী আহমেদ ভাইর উদ্দেশ্যে নিবেদন করলাম।

লেখাটি যে কেউ শেয়ার করতে পারেন।