হাদিস সংগ্রহ নিয়ে একটি গল্প চালু আছে। হাদিসগুলো সংগ্রহ করা হয় হযরত মোহাম্মদের (দঃ) এর মৃত্যুর অনেক পরে। ইমাম বুখারী, ইমাম তিরমিযি সহ অনেক সাধক হাদিস সংগ্রাহকরা সাহাবিদের সঙ্গে দেখা করে তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে হাদিস সংগ্রহ করে তা লিপিবদ্ধ করতেন।
ইসলামের প্রথম যুগে হযরত মোহাম্মদের (দঃ) সঙ্গে সর্বক্ষনিক যারা থাকতেন তারাই পরবর্তীতে সাহাবি হিসাবে চিহ্নিত-মর্যাদা পান। হযরত মোহাম্মদের(দঃ) বানী-আদেশ-নির্দেশ-পরামর্শগুলোই মুসলমানদের অনুসরনীয় হাদিস।
বিলুপ্তির আগেই এসব হাদিস সংগ্রহের জন্য এর সংগ্রাহকদের অনেক পরিশ্রম ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে। হাদিসটি চূড়ান্ত ভাবে লিপিবদ্ধ করার আগে তারা হাদিসটি নিয়ে আরও একাধিক সাহাবি’র সঙ্গে দেখা করে এর সত্য-মিথ্যা ভেরিফাই-যাচাই বাছাই করতেন ।
লেখার উপকরনও তখন আজকের মতো এত সহজলভ্য ছিলোনা। তখন হাতে বানানো কাগজ, গাছের ছাল, চামড়া, দেয়াল সহ নানাকিছুতে লেখা হতো এসব হাদিস। কোরান শরীফও এভাবে লেখা হয়। লেখার আগে কোরান শরীফ দীর্ঘদিন সাহাবি-হাফেজ সাহেবদের মুখে মুখে মুখস্ত আকারে ছিল।
উজবেকিস্তানের তাসখন্দ জাদুঘরে কাঁচের গ্লাসের ভিতর সংরক্ষিত বিশাল আকারের হাতে লেখা একটি কোরান শরীফ দেখে ধারনা করা গিয়েছিল লেখালেখি তখন কত কঠিন ছিল! ইমাম বুখারী উজবেকিস্তানের বুখারা শহরের মানুষ। তাঁর চিরশয্যা-সমাধিটিও বুখারায়।
একদিন এক হাদিস সংগ্রাহক এক সাহাবির বাড়ির সামনে গিয়ে একটি দৃশ্য দেখে তার কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহ না করেই ফিরে আসেন। ওই সংগ্রাহক দেখেন ওই সাহাবি তার গাধার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরন করছেন। দৃশ্যটি দেখেই তার মনে হলো এই ব্যক্তির কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহ করা ঠিক হবেনা।
ওই সংগ্রাহক ভাবলেন যে ব্যক্তি নিজের গৃহপালিত একটি নিরীহ পশুর সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর আচরন করতে পারে, তার ওপর নির্ভর করাটা বোকামির হবে। কারন এমন ব্যক্তি হাদিসের নামে সত্য-আধাসত্য-অসত্য মিলিয়ে প্রতারনাও করতে পারেন।
ডাঃ মুরাদ হাসানকে নিয়ে যখন পক্ষে-বিপক্ষে নানান বাহাস চলছিল তখন আমার মনে পড়েছিল হাদিস সংগ্রাহকদের সতর্কতার গল্পটি। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের এমন আকাল পড়েনি যে এমন লোক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ-উদ্দেশের প্রচার চালাতে হবে।
দলের জন্যে কখন কাদের দরকার এটা শেখ হাসিনা অনেক ভালো জানেন। ক্যাথলিক মোর দ্যান পোপ’দের তিনি চিনতে জানতে পারেন বলেই তিনি ১৩ বছর ধরে টানা ক্ষমতায়। জয়নাল হাজারী-শামীম ওসমান জাতীয় চরিত্রকেও ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সতর্কতার সঙ্গে সরিয়ে রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। অথচ আওয়ামী লীগের জন্যে তাদের ত্যাগও কম নয়।
আওয়ামী লীগ যারা করবেন বা করেন তাদের জন্য বেদবাক্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ। কারাগারের রোজনামচা সহ বঙ্গবন্ধুর বইপত্র যা কিছু এখন পর্যন্ত প্রকাশ পেয়েছে তাতেই বঙ্গবন্ধুর উৎস বৃত্তান্ত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
বঙ্গবন্ধুর উৎস বৃত্তান্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে পাওয়া যায়, এর মূল শিক্ষা-দীক্ষা হচ্ছে আজন্ম সংগ্রামী এই মানুষটি আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষ-বিনীত মানুষও ছিলেন। তিনি কোন অবস্থাতে একজন বেয়াদব অথবা দূর্বিনীত মানুষ ছিলেননা।
মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করতো ভালোবাসতো, কিন্তু ভয় পেতোনা। তাঁর কাছে যে কেউ তার মনের কথাটি অকপটে বলতে পারতো এবং এর একটা সমাধানও পেতো। একটা পাগলা কুকুরকে মানুষ ভয় পায় সমীহ করে চলে সেটি কামড়াবে বলে। এটিকে ভালোবাসা বলেনা।
পাকিস্তানি শাসক শোষকদের বিরুদ্ধে নিরাপোষ বঙ্গবন্ধু বিনীত ছিলেন দেশের চাষাভূষা-শ্রমিক সহ সব শ্রেনীর ভালো মানুষের প্রতি। কালোবাজারী, মুনাফাখোর, ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ-ষন্ডাগুন্ডাদের বিরুদ্ধে তাঁর ছিল জিরো টলারেন্স নীতি। বঙ্গবন্ধু একজন সত্যিকারের ধার্মিক এবং অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগ তাঁর নীতি আদর্শের অনেক কিছু থেকে সরে গেছে। এর গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো ধর্ম নিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরদিন সকাল থেকে বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষতার পথ থেকে সম্পূর্ণ সরে গিয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে চলার পাকিস্তানি পথে ফিরে যায়।
রেডিও-টিভিতে সেইদিন থেকে হামদ ও নাত, ধর্মীয় গান-গজল প্রচার শুরু হয়। লোকজনকে বোঝানো হয় এই শেখ মুজিবই ছিলেন যত নষ্টের মূল! দেশকে তিনি সিংহভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনার বাইরে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের তোষনের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন!
এরপর দীর্ঘ একুশ বছর আওয়ামী লীগকে এসব অপবাদ মাথায় নিয়ে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়েছে। বিশেষ করে দেশে নির্বাচন এলেই মসজিদ আবার মন্দির হয়ে যাবে, মসজিদে আজানের বদলে উলুধবনি হবে, মুসলামান মেয়েদের পরতে হবে শাঁখা-সিঁদুর, এসব প্রচারনা জোরদার হয়ে যেত!
জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া এদের সবাই এসব অপপ্রচারের নেতৃত্বে ছিলেন। এরজন্যে ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসার আগে শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের পোশাকে-আচরনে মুসলমানও সাজতে হয়েছে।
মতিয়া চৌধুরী তাঁর নির্বাচনী এলাকায় আন্দোলনের মাঠে মুনাজাতে বসলে তাকে আর পুলিশ উঠিয়ে দিতে পারতোনা। অথচ এই মতিয়াকে আওয়ামী লীগে যোগ দেবার আগে কট্টর বামপন্থী নেত্রী, অগ্নিকন্যা’ এসব বিশেষনে ভূষিত করা হতো। নারী মাওলানা হিসাবে নয়।
আওয়ামী লীগের অনেক নেতার মাথায় সেই যে গোলটুপি উঠেছিল তা আর নামেনি। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফিরলেও আওয়ামী লীগের সংবিধান সংশোধনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলোনা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগ তা কাজে লাগায়নি।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে সংবিধান সংশোধনের সংসদীয় কমিটি প্রতিদিন এই করবো সেই করবো বলে বাক-বাকুম করছিল। কিন্তু এই কমিটি যেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসে এরপর তাদের বাক-বাকুম থেমে যায়। সংবিধানে সংযোজিত জিয়া’র বিসমিল্লাহ, এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলম বহাল রেখে ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র নামমাত্র পুনর্বহাল করা হয় সংবিধান সংশোধনীতে।
অথচ এই দুটি অটুট রেখে ধর্ম নিরপেক্ষতা হয়না। যেমন বাজার অর্থনীতি বহাল রেখে হয়না সমাজতন্ত্র। কিন্তু এই দুটি অটুট রাখায় ধর্ম ব্যবসায়ীরা মাঠ গরমের যে সুযোগ পেতো, তাতে পানি ঢালেন শেখ হাসিনা। জাতির পিতার পোড় খাওয়া দুই কন্যা অনেক বাস্তববাদী। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদও বদলায়নি।
কাজেই ডাঃ মুরাদ যখন হঠাৎ করে ‘রাষ্ট্র ধর্ম মানিনা বিশ্বাস করিনা’ বলছিলেন, তখন তাকে যারা সমর্থন করেছিলেন, মনে হচ্ছিল তারা হয় শেখ হাসিনাকে জানেননা, পড়েননা, অথবা ২০০৯ সালের সংবিধান সংশোধনের সময় শিশু ছিলেন। এই দলকে ক্ষমতায় এনেছেন-ধরে রেখেছেন শেখ হাসিনা।
ডাঃ মুরাদ সমর্থক এই তরুনরা আওয়ামী লীগ অন্তপ্রান। পরে তারাও আত্মস্থ হয়ে বুঝতে পারেন আওয়ামী লীগ করতে হলে শেখ হাসিনার মতো করে করতে হবে। মুরাদের মতো করে নয়।
মুরাদরা এখানে পার্শ্ব চরিত্র মাত্র। রাষ্ট্র ধর্মের বিরুদ্ধে ডাঃ মুরাদের বিপ্লবী ভূমিকার সময় দেশের মানুষ তখনও তার ফুলের মতো পবিত্র চরিত্র সম্পর্কেও জানতোনা। জানার পর বুঝতে পারলো পার্শ্ব চরিত্র হিসাবেও তিনি শেখ হাসিনার ভাই নন, ভিলেন চরিত্রের।
নায়িকা মাহীকে নিয়ে ডাঃ মুরাদের ফোনালাপ প্রকাশের পর বিব্রত শেখ হাসিনা তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন। তাও সরাসরি নয়। ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে। এতে বোঝা যায় শেখ হাসিনা তাকে ফোন করে কথা বলার রূচিও হারিয়ে ফেলেছিলেন।
এমনিতে শেখ হাসিনা কাউকে একবার কোলে তুলে নিলে খুব সমস্যার না হলে তাকে এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেননা। মন্ত্রিসভার কত সদস্য আছেন যাদের নামও জানেননা দেশের মানুষ। এরপরও শেখ হাসিনার দয়ায় তারাতো ঠিকই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন খাচ্ছেন-দাচ্ছেন!
মুরাদ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হবার পর তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেছিলেন, তার অনেক কথায় সরকারকে নানান জায়গায় জবাব দিতে হয়েছে। রাষ্ট্র ধর্ম নিয়েই কথাটি বলেছেন তথ্যমন্ত্রী। হঠাৎ মন্ত্রিত্ব হারিয়ে সেই মুরাদ হাসান যখন কানাডা-আরব আমিরাতে গিয়ে ঢুকতে না পেরে মাথা নিচু করে দেশে ফিরে এসেছেন, তখনও অনেক কথা শুনতে হয়েছে সরকারকে।
এতদিন নীরবে-নিভৃতে থাকায় মুরাদ ইস্যু দেশের মানুষ ভুলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রীর ৯৯৯’এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা চাওয়া এবং লিখিত জিডি, পুলিশ পৌঁছবার আগে তার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা তাকে আবার মিডিয়ায় নিয়ে এসেছে। রীতিমতো বৌ পিটানোর অভিযোগ!
আওয়ামী লীগে যারা শেখ হাসিনার চাইতে অমুক অমুককে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তারাও হয়তো জানেন, শেখ হাসিনা অনেক কিছু সহ্য করেন। নারীর বিরুদ্ধে অবমাননা কিন্তু একদম সহ্য করেননা। শাহ এস এম কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া যে আওয়ামী লীগের ছায়া হারিয়ে এখন পথে পথে ঘুরছেন, এর পিছনেও আছেন একজন নারী।
স্ত্রী রীনা সুলতানার সংসারকে অবজ্ঞা করে রেজা কিবরিয়ায় তৃতীয় বিবাহকে শেখ হাসিনা অনুমোদন করেননি। রীনা সুলতানা যাতে অসহায় হয়ে না পড়েন শেখ হাসিনা তখন তার জন্যে বিদেশে চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন। এভাবে শেখ হাসিনা যখন যার আপা-মা বা নানী-দাদী হন, পুরো স্বত্ত্বা জুড়েই হন।
শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মী বা সহকর্মীদের দেখেননা, তাদের সংসারও দেখেন। অতএব মুরাদ হাসানের স্ত্রীর অভিযোগের পর তার কপালও স্থায়ীভাবে পুড়লো বলা যায়। মাহীর ঘটনার পর অনেকের মনে হচ্ছিল এমন একজন মুরাদ হাসানকে তার স্ত্রী-সন্তানরা সহ্য করেন কি করে।
মুরাদ হাসানই এর জবাব দিয়ে দিয়েছেন। বৌ পিটানোর অভিযোগ নিয়ে তিনি এখন সত্যিকারের বেকায়দায়।