শুধু ক্রিকেটের কারনে বিদেশের অনেক ভেন্যুতে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে। লালসবুজ পতাকা উড়তে দেখলে যে কি দারুন লাগে! আর দেশের ক্রিকেটের কারনে আমার কয়েক দফা নিউজিল্যান্ড যাওয়াও হয়ে গেছে। ২০০৭ সালে প্রথম যখন দেশটায় যাই, তখনও বাংলাদেশ দল নিউজিল্যান্ডে ছিল।
বাংলাদেশের সিডর দূর্গতদের সহায়তার জন্যে তখন বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ডের এক চ্যারিটি ম্যাচ হয়। মোহাম্মদ আশরাফুলের অধিনায়কত্বে সেই খেলায় বাংলাদেশ জিতেছিল। কিন্তু চ্যারিটি ম্যাচ হওয়ায় রেকর্ডের খাতায় সেই খেলার নাম নেই।
দেশে আমি মূলত রাজনৈতিক প্রতিবেদক ছিলাম। কিন্তু বিদেশে যখন বাংলাদেশ দল কোন ম্যাচ জিততো তখন টিএসসির প্রতিক্রিয়া জানতে কোন একজন ফটো সাংবাদিকের মোটর বাইকের পিছনে করে আমাকেই পাঠানো হতো।
বাংলাদেশের অনেক মিডিয়া একজন রাজনৈতিক প্রতিবেদককে দিয়ে গোল আলুর মতো সব রিপোর্ট করাতে চাইলেও খেলা ও অর্থনীতির মতো টেকনিক্যাল রিপোর্ট গোল আলু রিপোর্টার দিয়ে করানো সম্ভব নয়। এরজন্যে আমাকে যখন স্পোর্টস রিপোর্ট করতে পাঠানো হয়, আমি তখন পরিবেশের বর্ণনামূলক লেখার চেষ্টা করি। এজেন্সির কপি বা টিভি দেখে মূল রিপোর্ট ডেস্কের লোকজনই ভালো তৈরি করতে পারেন।
গত অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময় আমি অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন ভেন্যুতে বাংলাদেশের খেলাগুলো দেখতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ফেসবুকে এ নিয়ে আগডুম-বাকডুম করা দেখে বাংলাদেশের একটি মিডিয়া থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
তাদের স্পোর্টস রিপোর্টার ভিসা পাননি। তাই আমাকে তাদের জন্যে লেখার অনুরোধের সঙ্গে সম্মানী হিসাবে যে অর্থ প্রস্তাব করা হয় তা দিয়ে তাদের রিপোর্টার পাঠানো সম্ভব ছিলোনা। আমি আবার এসব নিয়ে আলোচনায় দর কষাকষিতে সংকোচ বোধ করি।
সেই সময়ে এক্রিডিটেশন কার্ডের জন্যে আবেদনের সুযোগও ছিলোনা। দেশে-বিদেশে স্পোর্টস সহ নানা ইভেন্টে এক্রিডিটেশন কার্ড করা না থাকলে কি ভোগান্তি পোহাতে হয় তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। মিডিয়া সেন্টার সহ একজন সাংবাদিকের জন্য দরকারি নানান ভেন্যুতে ঢোকা, এসবের সুযোগ সুবিধা ব্যবহার এক্রিডিটেশন কার্ড ছাড়া করা যায়না।
অতএব এক্রিডিটেশন কার্ডবিহীন সাংবাদিকতায় আমার ভূমিকাটি ছিল একজন পর্যটক-সাংবাদিকের মতো। টিকেট কেটে আমি গ্যালারিতে ঢুকে খেলা দেখে দেখে লিখছিলাম। সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ভালো করাতে আমাকে নিউজিল্যান্ডে দু’বার যেতে হয়েছে।
এডিলেইড ওভালে বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে হারানোয় আমাকে আবার দ্বিতীয় দফায় নিউজিল্যান্ড যেতে হয়। কী দারুন ব্যস্ততায় কেটেছে সেই দিনগুলো! সকালে নিউজিল্যান্ডের নেলসন থেকে সিডনি ফিরেছি। বিকেলে আবার এডিলেইডের ফ্লাইট!
নেলসন থেকে রওয়ানা হতে হতে বাসায় বলে রেখেছি মাশরাফির বাবা গোলাম মোর্তজা ভাইকে নিয়ে আসবো। ভালো খাবারের যাতে ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু সিডনি পৌঁছে তাকে হারিয়ে ফেলেছি। কারন পাসপোর্ট বৈষম্য। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের পাসপোর্টধারীদের জন্যে ছিল এক লাইন।
অন্যসব দেশের পাসপোর্টধারীদের লাইন আলাদা। আমাকে হারিয়ে ফেলায় মাশরাফির বাবাও বিমান বন্দরে তাকে নিতে আসা একজনের সঙ্গে চলে যান। বিকেলে এডলেইডের ফ্লাইটের জন্যে বিমান বন্দরে গেলে দু’জনের আবার দেখা হয়ে যায়। আমরা পাশাপাশি আসন নেই।
সিডনি থেকে এডিলেইড যেতে যেতে আমি জানার চেষ্টা করি একজন মাশরাফির উত্থান বৃত্তান্ত। ছেলেবেলায় মাশরাফি ব্যাটের অভাবে উঠোনে স্যান্ডেলকে ব্যাট ব্যবহার করেও ক্রিকেট খেলেছে। তাদের বিয়েটাও প্রেমের বিয়ে ছিল মাশরাফির বাবা-মা’র। সেই রিপোর্ট তখন পাঠক বেশ পছন্দ করেছেন।
একইভাবে মুশফিকের বাবা’র হাতে করে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো বেশকিছু জার্সি এসেছিল সিডনিতে। সেই জার্সি আনতে গিয়ে তাঁর কাছে শুনে লিখেছিলাম মুশফিকের উত্থান কাহিনী। কথা বলতে পারেননা মুশফিকে মা। কিন্তু ছেলের খেলা নিয়ে তার উৎসাহ-আগ্রহের কমতি নেই।
খেলার মাঠে মাশরাফি-মুশফিকের বাবাদের যারা দেখেছেন তাদের তাদেরকেও মনে থাকবে। ক্যনবেরার মানুকা ওভালে খেলা দেখতে গিয়ে মুশফিকের বাবা’র উচ্ছ্বাস দেখছিলাম। আমাকে তিনি বললেন, যেন মিরপুরে বসে খেলা দেখছি। মানুকা ওভালের খেলায় বাংলাদেশ আফগানিস্তানকে হারিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করেছিল।
সেই বিশ্বকাপের পর ভারতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হয়। অতএব ভারতের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশের খেলাগুলো দেখতে দেখতে আমি চলে যাই বাংলাদেশে। বাঙ্গালুরু স্টেডিয়ামে ভারত-বাংলাদেশের খেলা দেখতে আমাকে কালোবাজারে টিকেট কিনতে হয়েছে।
এরপর আবার নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ দলের সফরকে সামনে রেখে আমি এক্রিডিটেশন কার্ড করে নিয়েছিলাম। ওই সময়েই আমি প্রথম বাংলাদেশ দলের সবগুলো খেলার শহরে দলের পিছনে পিছনে ভ্রমনে যাই। ক্রাইস্টচার্চ দিয়ে শুরু। ক্রাইস্টচার্চ দিয়ে শেষ।
ওয়েলিংটনে বাংলাদেশ সে’বার দারুন খেলেছিল প্রথম ইনিংসে। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসেই যথারীতি সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে। সে’বার দলের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমি একটি কৌশল রপ্ত করেছিলাম! সেটা হলো খেলার আগে ম্যাচ প্রিভিউ যেটা লেখা হয় তখনই সব ভালোটা লিখে ফেলতে হবে।
খেলাতে যেহেতু সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে দিয়ে বাংলাদেশের, খেলা শেষে তখন আর ইতিবাচক কিছু লেখার সুযোগ থাকেনা। নিউজিল্যান্ডের বাউন্সি উইকেটে উপমহাদেশের দলগুলোর এমনিতে দাঁড়াতে সংগ্রাম করতে হয়। বাংলাদেশতো সেখানে নিত্য নিজেকে হারিয়ে খুঁজে! ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভের মাঠে প্রায় সব সময় ঝড়ো বাতাস বয়। বাংলাদেশ তেমন পরিবেশে খেলতে অভ্যস্ত নয়।
এবার বাংলাদেশের নিউজিল্যান্ড সফরে মাউন্ট মঙ্গানুইতে প্রথম টেস্ট হচ্ছে। পাহাড় আর সমুদ্র মিলিয়ে চমৎকার এক শহর মাউন্ট মঙ্গানুই। স্টেডিয়ামটাও সুন্দর। বাংলাদেশ একটি ভাঙ্গাচোরা দল নিয়ে এবার নিউজিল্যান্ড গেছে। মাশরাফি-মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ নেই। সাকিব-তামিম এরা এখন থেকেও নেই।
এমন একটি দল নিউজিল্যান্ড গিয়ে আহামরি কিছু করে ফেলবে তা নিশ্চয় কেউ আশা করেননি! পেস এ্যাটাকে এখন তাসকিন সিনিয়র। স্পিন বোলারদের মাঝে সিনিয়র মেহেদি হাসান মিরাজ! এমন একটি দল টস জিতে বোলিং নিয়ে দলকে দারুন এক সূচনা এনে দিয়েছে!
অনিয়মিত বোলার অধিনায়ক মমিনুল হক সৌরভ দুটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নিয়েছেন! একজন কনওয়ে সেঞ্চুরি করে তখন উড়ছিলেন। আরেকজন নিকোলস সেঞ্চুরির পথে হাঁটছিলেন। দ্বিতীয় দিনের প্রথম সেশনেই মেহেদি হাসান মিরাজের স্পিন ঘূর্নিতে নিউজিল্যান্ড গুটিয়ে যায় ৩২৮ রানেই।
সাদমান ইসলাম আর মাহমুদুল হাসান জয়কে বাংলাদেশের ব্যাটিং ইনিংস উদ্বোধন করতে দেখে নিশ্চয় খুব আশাবাদী মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা গিয়েছে। মাহমুদুল হাসানের এটি আবার দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ম্যাচ। কিন্তু এই দুই তরুন তাদের অনেক মুরব্বির তুলনায় যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন।
টেস্ট ক্রিকেটে খুব গুরুত্বপূর্ণ হলো এমন ধৈর্য। টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্টের মতো নিউজিল্যান্ডের পরিবেশের আগুন বোলারদের দেখেশুনে খেলেছেন বাংলাদেশের নবীন দুই ওপেনার। সাদমান উইকেটে বেশি সময় না টিকলেও নিল ওয়াগনরের সেই ইয়র্কারটি ছিল দূর্দান্ত একটি ডেলিভারি।
শতরানের জুটি গড়ে নাজমুল হাসান শান্ত আশা ছড়াচ্ছিলেন। কিন্তু মনোযোগ হারানোয় তিনি নিল ওয়াগনরের দ্বিতীয় শিকার হন। এরপর মাহমুদুল হাসান জয়কে সঙ্গ দিতে এসে দ্বিতীয় দিনের শেষ বল পর্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন ক্যাপ্টেন মমিনুল হক সৌরভ।
মাহমুদুল হাসান জয় তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতক ও অপরাজিত সত্তুর রানে দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ করেছেন। আমিও খেলার তৃতীয় দিনে কী দাঁড়াবে সে অপেক্ষায় না থেকে ভালো অবস্থা থাকতে থাকতে একখানা রচনা লিখে ফেললাম। ভালো হলেতো ভালোই।
আমাদের এই ক্রিকেট দলটা যখন ভালো করেনা তখন আপনারা যখন যা খুশি বলেন লিখেন তখন বড় অসহায় লাগে। আল্লারওয়াস্তে আসল সমস্যার দিকে তাকান। আসল সমস্যা পাপন এন্ড কোম্পানিতে। এমন অযোগ্য অথর্ব বোর্ড দ্বিতীয় কোন দেশে পাবেননা।
এই পাপন এন্ড কোম্পানি আট বছর ধরে বিসিবি লুটেপুটে খাচ্ছে। মাশরাফি-মুশফিক-রিয়াদ-সাকিব-তামিম আট বছর আগের প্রোডাক্ট। এই পাপন এন্ড কোম্পানির নতুন কোন সৃষ্টি নেই, পাইপ লাইন নেই। পৃথিবীর কোন যোগ্য কোচ এদের কারনে বাংলাদেশে আসতে চায় না, এলেও থাকতে পারেনা।
দেশের কোচদের এরা কোনদিন কাজে লাগায়নি। বাংলাদেশের ছেলেগুলো প্র্যাকটিসের মাঠ পায়না, যে ছেলেটা আজ দল থেকে বাদ পড়ছে সে যে ফিরে আসবে সে আর কোন মাঠে ঢুকতে পারেনা। কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক দাপটে দেশের ক্রিকেটের রক্ত চুষে খাচ্ছে এই পাপন এন্ড কোম্পানি। পারলে এদের তাড়ান। ক্রিকেটেও তখন নতুন বাংলাদেশ দেখবেন।