বরিশাল পুলিশের গেটের বাইরে অচ্ছ্যুত পরিত্যক্ত আসপিয়া মেয়েটির হতাশ বসে থাকার ছবিটি ছিল আমাদের জাতীয় লজ্জা আর অপরাধের ছবি! কে ছবিটি প্রথম তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করেছিলেন? তাকে সালাম।
আমাদের শৈশবে আমরা বাজারে রেষ্টুরেন্টের বাইরে এমন ছবি দেখতাম ধাঙ্গড়দের। শহর পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে জড়িত ধাঙ্গড়দের রেষ্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকে বসে খাবার অধিকার ছিলোনা।
তাদের খাবার দেয়া হতো রেষ্টুরেন্টের বাইরে। চা দেয়া হতো তাদের নিজস্ব কাপে! এই যুগে আপনি যদি মানুষ হন আসপিয়ার ছবি দেখে আপনি কাঁদবেনই। এ যেন আমাদের অচ্ছ্যুত এক মা-মনি। আমাদের ঘরের অথবা পাশের বাড়ির মেয়ে। আমাদের মেয়ে, ভাই-বোন ঝি অথবা আমাদের আদরের ছোটবোন।
যে কারো দয়া-অনুগ্রহ নয়, কাজ করতে চায়। পুলিশ কন্সটেবলের চাকরি করে অভাব দূর করতে চায় অভাবী মায়ের সংসারের। এমন ব্রত নিয়ে আমাদের আসপিয়া ইসলাম পুলিশের চাকরির জন্যে গিয়েছিল। পুলিশের চাকরির সব পরীক্ষায় সে পাশও করেছে। কিন্তু শুধু পাশ করতে পারলোনা পুলিশের গোলামীর আইনের পরীক্ষায়!
ব্রিটিশ আমলে পুলিশের আইনে এই গোলামীর ধারা সংযুক্ত করা হয়। গোলামকে সময়মতো ধরে আনতে তার একটা স্থায়ী ঠিকানা চাই! স্থায়ী ঠিকানা মানে নিজেদের একটি জমি অথবা বাড়ি থাকতে হবে! শিশুকালে বাপ হারানো পরের জমিতে বড় হওয়া আসপিয়ারা এই দেশের আইনের সংজ্ঞায় ভূমিহীন!
ব্রিটিশ গেছে পাকিস্তান গেছে, বাংলাদেশ এসেছে, কিন্তু গোলামীর ব্রিটিশ আইনটি বাতিল করা হয়নি! এখনও নয়! আসপিয়ার ছবিটি প্রথম দেখে যে কারো অশ্রু সম্বরন করা কঠিন। পুলিশ লাইনের বাইরে বসা মেয়েটি যেন এই দেশ-সমাজ সবার কাছে কৈফিয়ত প্রার্থিনী! কিসের এই দেশে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপনের নামে বছরব্যাপী উৎসব চলছে! যেখানে এই দেশ আজও পরাধীন ব্রিটিশ আমলের পরাধীন নীতি আদর্শ অটুট ধরে রেখে চলেছে!
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসপিয়ার ছবিটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে তাঁর প্রতি আবেগ-ভালোবাসার ঢল নামে। সঙ্গে রাজ্যের বিস্ময়! এই সময়ে জানা যায় এর আগে কুলাউড়ার গাজীপুর চা বাগান ও কমলগঞ্জ চা বাগানের দুই চা শ্রমিক সন্তানের পুলিশের চাকরি নিয়েও একই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। কারন চা বাগানের শ্রমিক পল্লীতে জন্ম নেয়া বড় হওয়া সেই দুই চাকরি প্রার্থীও পুলিশের চাকরির সংজ্ঞায় ভূমিহীন! পরে আইজিপির উদ্যোগে সেই দু’জনের চাকরি হয়। তারা এখন সিলেটে চাকরি করছেন।
আসপিয়ার বিষয়টিতে ক্ষোভ জানিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ফেসবুক পোষ্টে বলেন, তাঁর চাকরি না হলে তিনি অনশনে বসবেন। নব্বুইয়ের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার ছাত্রনেতা শফি আহমেদ সহ আরও অনেকে সংহতি জানিয়ে বলেন তারাও তাঁর সঙ্গে অনশনে বসবেন নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে।
আসপিয়ার দূর্গতির খবর শুনে অনেকে তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসেন। জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব এবং বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য সচিব ইকবাল হোসেন তাপস তাঁকে এক খন্ড জমি কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। আসপিয়ার ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে তিনি তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন, এতে তাঁর ভূমিহীন সমস্যার অবসান হবে।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার এক মাদ্রাসা শিক্ষক নূর ই আলম মিন্টু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসপিয়ার ব্যাপারটি দেখে তাঁকে জমি কিনে দিতে চান। আসপিয়া তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগী হয়ে তাঁর জমি-ঘর এবং চাকরির ব্যবস্থা করছেন।
ইতালি প্রবাসী এক ভদ্রলোক আসপিয়ার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। আসফিয়ার কাছে তিনি তাঁর ফোন নাম্বার দিয়ে বলেন, জমি বা যে কোন প্রয়োজনে আসপিয়া যাতে তাকে ফোন করেন। আসপিয়াকে তিনি বলেন, খবরটি পড়ার পর থেকে তিনি বিচলিত বোধ করছেন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নেবার পর পুলিশ কথার সুর পাল্টায়! পুলিশ তখন বলে তারা আসপিয়াকে চাকরি দেবেনা এমন কথা কোথাও বলেনি। পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় তার একটি তথ্যে ভুল পেয়েছে।
বরিশালের জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার প্রধানমন্ত্রীর অফিসের ফোন পাবার পর তাঁর তাড়ায় হিজলার ইউএনও বকুল চন্দ্র কবিরাজ আসপিয়াদের ঘর বানাতে জমি খুঁজতে বেরোন। প্রাথমিকভাবে জমি নির্বাচন ও জমির দলিলও এরমাঝে আসপিয়ার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
মোটকথা, এভাবে ভূমিহীন অপবাদ দূর করে আসপিয়াকে চাকরি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখরক্ষা করছে বাংলাদেশ পুলিশ! কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র এখনও ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া গোলামীর আইন-পুলিশে চাকরি পাবার শর্তযুক্ত ধারাটি বদলাতে নারাজ!
আমলাতন্ত্রকে এর কারন জিজ্ঞেস করতে রাজনীতিকদের সাহস সৃষ্টিতে পঞ্চাশ বছর সময় কী যথেষ্ট নয়? আসপিয়া কান্ডের পর পুলিশ কী গোলামীর ধারাটি পাল্টাবে? অথবা বলবে কী কারনে তাদের পক্ষে এটা পাল্টানো সম্ভব নয়?