সাংবাদিকতায় আমরা সেই সৌভাগ্যবান প্রজন্ম যারা হায়দার আকবর খান রনো ভাই'র মতো রাজনীতিকদের বন্ধুত্ব পেয়েছি। আমাদের পেশা জীবন বেড়ে উঠেছে তাদের অভিজ্ঞতার আলোছায়ায়। ছোটন ভাই'র প্রতি এই সুযোগে আবার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নেই। নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন। স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুবনেতা। তিনি আমাদের রাজনৈতিক মেধা গঠনে প্রভাব তৈরি করেন। এই ছোটন ভাই'র মাধ্যমেই রনো ভাই'র সঙ্গে আমার যোগাযোগ-বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
এই ছোটন ভাইর মাধ্যমেই আমি বিচিন্তার জন্যে যখন রনো ভাইর ইন্টারভ্যু করি। তখন গ্রেফতার এড়াতে তিনি তখন আত্মগোপনে ছিলেন। আমাকে তিনি বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন-পারতেন বলে ওই অবস্থায় ইন্টারভ্যু দেন। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে তখন চারপাশে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনৈতিক ঐক্য তখনও এই ভাঙ্গে এই গড়ে। ১০ নভেম্বরের পরের কর্মসূচি কী হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছিল না। রনো ভাই আমাকে বলেন, ফজলুল বারী, আমরা পরীক্ষার আগের রাতে পড়াশুনা করে পাশ করা ছাত্র। দেখবে, আমাদের কর্মসূচির অভাব হবেনা। ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হবার পর কর্মসূচির অভাব হয়নি।
ঢাকায় আমরা তখন চাল-চুলোবিহীন উঠতি সাংবাদিক। নিয়মিত নিরাপদ চাকরিও ছিলোনা। রনো ভাইদের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আড্ডার সুযোগে কত যে তাদের বাড়িতে খেয়েছি। তাঁর মেয়ে রানা, বোন পুতুল তখন কিশোরী স্কুল ছাত্রী। রনো ভাই, তাঁর স্ত্রী হাজেরা সুলতানা তখন ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা। রনো ভাই, হাজেরা আপা প্রতিদিন সকালে বাইরে বেরুবার আগে তাদের মায়ের কাছ থেকে হাত খরচ-রিকশা ভাড়া নিয়ে বেরুতেন। এ নিয়ে রনো ভাইকে প্রায় মজা করে বলতাম, আপনিতো মায়ের কাছ থেকে রিকশাভাড়া নিয়ে বিপ্লব করতে বেরোন।
আমি সেই বয়সে যে সব রাজনীতিকের সঙ্গে সিগারেট খেতাম রনো ভাই তাদের অন্যতম। বাসায় গিয়েই জিজ্ঞেস করতাম, সিগারেট আছে? রনো ভাই চুপচাপ মায়ের কাছে টাকা চেয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কলাবাগানের মোড়ের দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনে নিজে জ্বালাতেন, আমাকেও জ্বালিয়ে দিতেন। রনো ভাই'র শ্বাসকষ্টের সমস্যা করোনারও অনেক আগের। আমি অস্ট্রেলিয়া আসার পর ছোটন ভাই একদিন ফোনে বলছিলেন, শ্বাসকষ্টের সমস্যায় রনো ভাই গাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ঘোরেন। তাঁর শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুনে আমি তাই অনেক অপরাধবোধে ভুগি।
সোভিয়েত-চীন ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক বিভাজনে বাংলাদেশে রনো ভাইর অবস্থান ছিল সোভিয়েত বিরোধী শিবিরে। যদিও বাংলাদেশে বরাবর সোভিয়েত শিবির শক্তিশালী ছিল। সোভিয়েত-চীন ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক প্রভাব ভেঙ্গে পড়লে কেউ কেউ ক্ষুদ্র গ্রুপ তৈরি করেছেন। কেউ মিশে গেছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে। রনো ভাইর মতো প্রভাবশালী তাত্ত্বিক নেতা তা না করে যোগ দিয়েছেন সিপিবিতে। সিপিবিও তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ পদ দিয়েছে। তাঁর একমাত্র সন্তান রানা সুলতানাও বিদেশে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সমাজতান্ত্রিক নেতার পরিচয়েই মারা গেলেন দেশের একজন স্বচ্ছ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রনো ভাই। এমন সৌভাগ্য সবার হয়না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে পড়ুয়াদের সংখ্যা বিস্তর কমেছে। হায়দার আকবর খান রনো সর্বশেষ সেই রাজনীতিকদের অন্যতম যারা পড়তেন, লিখতেন। সর্বশেষ তিনি লিখতেন প্রথম আলোর মতো একটি মূলধারারা পত্রিকায়। তাঁর প্রকাশিত অনেক বই আছে। করোনার সময় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেরও অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেতা মারা গেছেন। তখন করোনায় আক্রান্ত হয়েও তিনি টিকে যান। তিনি যে একজন লড়াকু মানুষ তা দেখেশুনে আশাবাদী হই। এবারও মেয়ে রানা'র ফেসবুক পোষ্টে যখন তাঁর জটিল শারীরিক পরিস্থিতির খবর পড়ি, তখনও আশাবাদী হতে ইচ্ছে করেছে। কিন্তু ততোক্ষনে শরীরে কার্বন মনোক্সাইডের আধিক্যের প্রভাব যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তা আর তিনি সামাল দিতে পারেননি।
তবু তাঁর মৃত্যুটাও তাঁর চাওয়া মতো হয়েছে! লাইফ সাপোর্টে নিয়ে গিয়ে অনেকে যে শেষমূহুর্তের টানাহেঁচড়া করেন, তা তিনি করতে দেননি। সন্ধানীতে কর্নিয়া দিয়ে যাওয়ায় তাঁর চোখে বাংলাদেশ দেখবেন সৌভাগ্যবান দু’জন। তিনি বাংলাদেশের সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অনন্য এক দৃষ্টান্ত। পারিবারিক কারনেও শেখ হাসিনা, সুলতানা কামাল, হায়দার আকবর খান রনো বেড়ে উঠেছেন একই সড়কের পাশাপাশি বাড়িতে।
বিদায় প্রিয় রনো ভাই। এই জীবনে আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন যিনি বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় দেশপ্রেমিক বিপ্লবী রাজনীতিক কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর সান্নিধ্য-স্নেহ পেয়ে শিখেছি সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব জানতে-বুঝতে চেষ্টা করা। আপনার বিশ্রাম শান্তিময় হোক। বাংলাদেশের অনুসন্ধিৎসু নতুন প্রজন্ম নিশ্চয় আপনার জীবন ও রাজনীতি নিয়ে আগামীতে গবেষনা করবে। তাদের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে দেশে হায়দার আকবর রনোর মতো সৎ দেশপ্রেমিক বিপ্লবী রাজনীতিকও ছিলেন।