প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

মির্জা ফখরুলদের হৃদয়ে পাকিস্তান

ফজলুল বারী

প্রকাশিত: ১৬:৫২, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

মির্জা ফখরুলদের হৃদয়ে পাকিস্তান

মির্জা ফখরুলদের পাকিস্তানে ভালো থাকার আক্ষেপ এখন রাজনীতিতে আলোচিত প্রসঙ্গ। বিএনপির মহাসচিব তার নিজের ও দলের মনের কথাটি বলে ফেলেছেন। হৃদয়ে পাকিস্তান! তাকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব!

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নেতা হাবিব পরে ঈশ্বরদীর একটি মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিএনপিতে যোগ দেন। শুক্রবার রাতে একাত্তর জার্নালে হাবিব শুধু মির্জা ফখরুলের পাকিস্তান ভালো বক্তব্যকেই সমর্থন নয়, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃ্ত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন!

রাজশাহীর ছাত্রলীগ নেতৃত্ব নিয়ে সমকালের রিপোর্ট প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল সমালোচনার সময়ে হাবিবুর রহমান হাবিবও এখন চোখের সামনে! কে কী ভাবে ছাত্রলীগের নেতা হয়ে যাচ্ছেন আর ডিগবাজি খাচ্ছেন তা খতিয়ে দেখার এখনই সময়।

মির্জা ফখরুল যে ঠাকুরগাঁও’র চখা মিয়া রাজাকারের সন্তান তা আমি জনকন্ঠে লিখেছিলাম গত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে। আমি তখন ওই এলাকার জেলাগুলোর রাজনীতি নিয়ে ধারাবাহিক রিপোর্ট করছিলাম। ঠাকুরগাঁও গিয়ে মির্জা ফখরুলের বাড়ির নাম শুনেও তখন চমকে উঠি।

মির্জা ফখরুল তখন বিএনপির দ্বিতীয় তৃতীয় সারির নেতা হলেও স্থানীয় দুর্নীতির হেডকোয়ার্টার হিসাবে তার বাড়িটি ছিল গোটা এলাকার আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে। সেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখন সুবোধ চক্রবর্তী! প্রতিদিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন!

ঢাকায় দুর্নীতি-অপশাসনের হেডকোয়ার্টার ছিল হাওয়া ভবন। তারেক রহমান, তার বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তারেকের মামা সাঈদ ইস্কান্দার, শামীম ইস্কান্দার সহ আর কিছু রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত নিয়ে হাওয়া ভবন চালাতেন।

স্যামসাং সহ কত কোম্পানি যে তখন হাওয়া ভবনের দুর্নীতির দাপটে বাংলাদেশে বিনিয়োগ না করে চলে যায়। স্যামসাং পরে বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করাতে সেদেশের জিডিপি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। তারেকের ঘুষের টাকা সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেছে মার্কিন চ্যানেলে।

ঠাকুরগাঁও শহরে মির্জা ফখরুলদের বাড়িটি তখন হাওয়া ভবনের স্থানীয় সংস্করন হিসাবে বাতাস ভবন নামে আলোচিত-নিন্দিত-ঘৃণিত ছিল। বাতাস ভবন চালাতেন মির্জা ফখরুলের ছোট ভাই ইকবাল। ওই এলাকার কয়েক জেলার সমস্ত সরকারি কাজের ঠিকাদারি পেতে বাতাস ভবনকে খুশি করতে হতো।

মির্জা ফখরুলের বাবা মির্জা রুহুল আমিন চখা মিয়া মুক্তিযুদ্ধের আগে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। আর মির্জা ফখরুল করতেন মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন। এই ছাত্র সংগঠনটি তখন মাওলানা ভাসানীর অনুসারী ছিল। চীনপন্থী মাওলানা ভাসানী নির্বাচন করতে চাইতেননা।

কারন আওয়ামী লীগ ছাড়ার পর তিনি নিজে দিনে দিনে ছোটদলের বড় নেতায় পরিণত হন। এরজন্যে ভোটের আগে ভাত চাই, ভোটের বাক্সে লাথি মারো শ্লোগান দিয়ে সত্তুরের নির্বাচনও বর্জন করে ভাসানী ন্যাপ। চীন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন নিয়ে চীনপন্থীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে।

মাওলানা ভাসানী ভারতে গেলেও তার দলের সাধারনত সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়া ভারত থেকে চলে এসে পাকিস্তানের পক্ষ নেন। এই রাজাকার যাদু মিয়াকেও জিয়াউর রহমান দল করার সময় সঙ্গে পেয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি আলোর মুখ দেখার আগেই হঠাৎ যাদু মিয়া মারা যান।

তার ছেলে শফিকুল গানি স্বপন আমাকে বলেছিলেন তার পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। যাদু মিয়ার মেয়ে রিটা রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনি একজনের স্ত্রী। গত নির্বাচনে বিএনপি রিটা রহমানকে নীলফামারী জেলায় প্রার্থী করেছে। বিএনপি শুরু থেকে এখনও এমন গোলমেলে পার্টি।

ঠাকুরগাঁও সীমান্তের ওপারের ইসলামপুরে মির্জা ফখরুলের নানা বাড়ি। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ঠাকুরগাও দখলে নিলে মির্জা ফখরুলের পরিবারটি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইসলামপুরের নানা বাড়িতে গিয়ে ওঠে। মির্জা রুহুল আমিন চখা মিয়াও শুরুর দিকে শশুরবাড়ি ভারতে যান।

ওই সময়ে ইসলামপুরে একটি বোমা বিস্ফোরনের ঘটনা ঘটলে ভারতীয় পুলিশ সন্দেহ করে মির্জা ফখরুলকে ধরে নিয়ে যায়। মির্জা ফখরুলের মামার গোষ্ঠী তখন ভাগ্নেকে বাঁচাতে সেখানে অবস্থানরত প্রবাসী আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে যান।

তখন সেই আওয়ামী লীগ নেতারা থানায় গিয়ে মির্জা ফখরুলকে ছাড়িয়ে আনেন। কিন্তু মির্জা ফখরুলের পরিবারটি ভারতে বেশিদিন থাকেনি। শরণার্থী সহ স্থানীয় কিছু যুবক মির্জা ফখরুলের সুন্দরী দুই বোনের পিছু নিয়েছে এই অভিযোগে পরিবারটি পাকিস্তানীদের কাছে চলে আসাকেই নিরাপদ মনে করেছে।

ঠাকুরগাঁও ফিরে মির্জা ফখরুলের বাবা মির্জা রুহুল আমিন চখা মিয়া মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তান রক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতার পর কারাগারকে ধন্য করেন চখা মিয়া। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আর সব পাকিস্তানপন্থীদের মতো জিয়ার দলে যোগ দেন।

আবার জিয়ার মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে ছেড়ে এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে প্রতিমন্ত্রী হন মির্জা ফখরুলের বাপ চখা মিয়া। এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হবার পর চখা মিয়া আবার বিএনপিতে ফিরে আসেন। বিএনপি নেতার পরিচয়েই ১৯৯৭ সালে তার মৃত্যু হয়। আর বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে ২০০৫ সালে মির্জা ফখরুল মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম তোলেন।

মির্জা ফখরুলের নেত্রী খালেদা জিয়া এর আগে মুক্তিযুদ্ধের তিরিশ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিতর্কিত হন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করে লন্ডনে তারেক রহমানের নানা বক্তব্যে বিভিন্ন সময়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বক্তব্য রেখেছেন হালের বিএনপির ঘনিষ্ঠ কাদের সিদ্দিকী।

আর মির্জা ফখরুল সর্বশেষ ঠাকুরগাঁওর বাড়ি বাতাস ভবনে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পাকিস্তান সরকার থেকে বর্তমান সরকার আরও নিকৃষ্ট। আমরা পাকিস্তান আমলে আর্থিক ও জীবনযাত্রার দিক থেকে এর থেকে ভালো ছিলাম!’ এটা কী কোন মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্য? না রাজাকারের সন্তানের?

পাকিস্তানের ভিক্ষুক রাষ্ট্রের পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে এই আশংকায় পাকিস্তান বাংলাদেশের বন্যা ত্রান নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এরপরই মির্জা ফখরুল বললেন পাকিস্তানে তারা ভালো ছিলেন! আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন মির্জা ফখরুলের বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহের সামিল। মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম চখা মিয়া রাজাকারের ছেলেকে ছেড়ে দেবেনা।