প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

আমার জন্মদিন

ফজলুল বারী

প্রকাশিত: ০৩:২৫, ২৩ আগস্ট ২০২২

আমার জন্মদিন

আমার আব্বা মোহাম্মদ জহির আলী হবিগঞ্জ পিটিআইতে থাকার সময় আম্মা ফখরুন্নেসা খানমের দ্বিতীয় সন্তান হিসাবে হবিগঞ্জ শহরে আমার জন্ম। আব্বা তখন সেই পিটিআইর ডেপুটি সুপারেন্টেডেন্ট ছিলেন। আমার জন্মের পর সুপারেন্টেডেন্ট পদে তাঁর পদোন্নতি ঘটে। বদলির চাকরি ছিল তাঁর।

আলীগঞ্জ (হাজীগঞ্জ), লক্ষীপুর, ভোলা, মৌলভীবাজার পিটিআই জীবনের কথা আমার মনে আছে। মৌলভীবাজার পিটিআইতে আসার পর সরকারি চাকরি থেকে তাঁর অবসর হয়। কিন্তু আমার আব্বার অবসর হয়না। ছেলেমেয়েরা কর্মক্ষম না হয়ে ওঠায় অনেকগুলো টিউশনি করে তিনি সংসার চালাতেন।

অনেক ভাইবোনের সংসারে তাই আমার শৈশব কেটেছে চরম দারিদ্রের ভেতর। আমাদের পরিবারে কারও জন্মদিন পালন হতোনা। জন্মদিন কবে তা শৈশবে জানতামও না। দেশে থাকতে কখনও আমার জন্মদিন পালন হয়নি। বিয়ের পর আমাদের সংসারে প্রথম অমর্ত্যর জন্মদিন পালন করা হয়।

হাতিরপুল এলাকার এক চীনা রেষ্টুরেন্টে অমর্ত্যর প্রথম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমাদের অনেক সাংবাদিক বন্ধুদের সপরিবারে দাওয়াত করা হয়েছিল। এখন ফেসবুকের কারনে আমরা আমাদের জন্মদিন এভাবে জানি। আমার একদল প্রিয় প্রজন্ম একবার কাজ থেকে ফিরে মধ্যরাতে সিডনির লাকেম্বা রেলস্টেশনে কেক কেটেছিলেন।

ওয়ালি পার্কের বাসায় একবার আমার জন্মদিন বেশ ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হয়। আব্বাকে নিয়ে এমন ধুমধাম অমর্ত্য ছোট্ট জীবনে প্রথম ও শেষবার দেখেছে। আমরা তখন প্রায় আমাদের প্রিয় প্রজন্ম ছেলেমেয়েদের জন্মদিন উপলক্ষে লাকেম্বার গ্রামীন রেষ্টুরেন্টে কেক কাটতাম।

আটাশ ডলারে পাওয়া যেত বেশ বড়সড় কেক। কোন কোনদিন কাটতে হতো একাধিক কেক। লাকেম্বার সেই কেক কেনার দোকানে তখন একজন বাংলাদেশী কর্মী থাকায় কেকে তিনি তখন বাংলায় শুভ জন্মদিন লিখে দিতে পারতেন। অমর্ত্যর হঠাৎ মৃত্যু আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে।

আমরা এখন আর কোন উৎসবে যাইনা। অথবা উৎসব এড়িয়ে চলি। আগে প্রতিদিন সকালে ফেসবুকের নোটিফিকেশন দেখে ফেসবুক বন্ধুদের জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতাম। অনেকের জন্মদিন উপলক্ষে আলাদা করে লিখতামও। এখন আর তা লিখা হয়না।

আমাকে অনেক মানুষ ভালোবাসেন বলে ফেসবুক দেখে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর ঝড় তোলেন। অনেকে লিখেন ইনবক্সে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে প্রতিবারের মতো এবারও অনেকে আমাকে গোপনে ইনবক্সে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এরা মূলত আওয়ামী লীগ সমর্থক।

আমার লেখাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের লোকেরা প্রায় ক্ষুদ্ধ হন। তাদের ভয়ে এই পক্ষ গোপনে ইনবক্সে শুভেচ্ছা জানান। বিষয়টি মজার তাইনা? আমরা সারাক্ষন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলি। বাংলাদেশে এখনও এর পরিবেশ তৈরি হয়নি। সময় লাগবে।

এবারেও যারা আমাকে প্রকাশ্যে এবং গোপনে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাদের সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাই। এত ভালোবাসার যোগ্য আমি আসলে নই। তবে সবার মতো আমিও আমার দেশ এবং দেশের মানুষকে প্রানভরে ভালোবাসি। সারাক্ষন চিন্তা করি কাকে কিভাবে সহায়তা করা যায়।

আমার সামর্থ্য কম। এরপরও সারাক্ষন এই দেবো সেই দেবো এমন স্বপ্নের মধ্যে থাকি। ছেলেবেলায় আমার এলাকায় কৃষি ভিত্তিক কমিউন সৃষ্টির কথা ভাবতাম। এখন দেশের যখন যা দরকার তা আয়োজন করে ফেলার কথা কল্পনায় ভাবতে থাকি।

যেমন একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ার কথা ভাবি, কার কী দরকার। সবার দরকার সমূহ নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি হচ্ছে এবং আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের তা পৌঁছে দিচ্ছেন! সবাইকে একটু করে সাপোর্ট পারলেই বাংলাদেশ আরও দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। একদিন আমাদের সব হবে।

অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের খাবার ঘরগুলোয় আমরা এরমাঝে জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী পালনের ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছি। এখানে যারা খেতে আসেন তারা এত গরিব যে তাদের কখনও জন্মদিন পালন করা হয়না। আমরা তাদের দিয়ে জন্মদিনের কেক কাটাই। এভাবে খাবার খেতে এসে কেক খেতে পারাটা তাদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়।

আমাদের যারা ডোনার তারা নিজের অথবা প্রিয়জনের জন্মদিন উপলক্ষে টাকা যখন পাঠান তখন আমরা এসব সুবিধাবঞ্চিতদের দিয়ে কেক কাটা, দোয়া করানোর ব্যবস্থা করি। এভাবে আমাদের গরিবের খাবার ঘরগুলোর মেহমানরা জন্মদিনের কেক খেতে পেরে খুবই আনন্দিত হন।

সামান্য টাকায় একেকটি খাবার ঘরে প্রতিদিন এক-দেড়শ ছেলেমেয়ে এবং সুবিধাবঞ্চিতদের মাধ্যমে জন্মদিন পালন, অনেকের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। এভাবে আমরা মৃত্যুবার্ষিকীর আয়োজনও করি। আমাদের মেহমানরা মৃতের উদ্দেশে দোয়া করেন। এই দিনগুলোয় ভালো খেতে পারায় তারা কৃতজ্ঞ।

অমর্ত্য ফাউন্ডেশন গরিবের হেঁসেলে মূলত বাচ্চারা খেতে আসে। এই খাবার ঘরে তাদের জন্যে দুধভাতের ব্যবস্থাও করা হয়। এই বাচ্চাদের প্লেট হাতে দুধভাত খাবার দৃশ্য দেখে অনেকে প্রিয়জনের জন্ম-মৃত্যু দিবসে এই খাবার ঘরে আয়োজনের দিকে ঝুঁকছেন। এমন সবাই মিলে আমরা একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়বোই। সবাইকে আবারও অভিনন্দন।

আরো পড়ুন